ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোরের আরও স্মৃতি (১৭ অক্টোবরের পর) প্রথমেই ২/৩টি সিলেটী শব্দ নিয়ে কিছু বলতে চাই। একটি হলো ‘খাউরি’। কোন ছাত্রকে নানা কথা বলে চটাতে সক্ষম হলে তাকে বলা হতো ‘খাউরি’ এবং নানাভাবে চটানোর জন্য বার বার তাকে সেই শব্দে ডাকা হতো। প্রায় বছর দুয়েক আমাকে ‘খাউরি’ বানানোর প্রচেষ্টা বেশ সফল হয়। আমাকে কতিপয় সহপাঠী ‘উড়িষ্যা’ নামে খাউরি বানাত। এই যে একটি অবস্থান থেকে কি করে যে বেরিয়ে যাই সেটা আমার মনে নেই। কিন্তু এখন ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, এই নির্দোষ ‘উড়িষ্যা’ শব্দটি আমাকে প্রায় দুই বছর বিভিন্নভাবে নাজেহাল করে। আর একটি শব্দ হলো ‘ফুটানি’। কেউ সুন্দর কাপড় পরে এসেছে বা ভালভাবে সাজগোজ করেছে তার সম্বন্ধে বলা হতো ‘ওর বেশ ফুটানি হয়েছে’ এবং তাকে তার এই ‘ফুটানি’র জন্য খোঁটা দেয়া হতো (এত ফুটানি মারছিস কেন?)। আর একটা শব্দ ছিল ‘মিসকি শয়তান’। খুব সাদাসিধে গোবেচারা একজন ছাত্র; কিন্তু দুষ্টুমিতে সে ওস্তাদ আর দুষ্টুমি করে খুবই গোপনে। তাকে বলা হতো ‘মিসকি শয়তান’। অনেক সময় এ রকম দুষ্টু ছেলে নিজে সামনে আসত না, সাদাসিধে কোন ছেলেকে বুদ্ধি দিয়ে কাউকে অপদস্থ করতে ব্যবহার করত। এই ধরনের মিসকি শয়তানদের আমি খুব অপছন্দ করতাম। তারা কিন্তু সহজেই অন্য ছেলেদের বুদ্ধি দিয়ে আমাকে ‘খাউরি’ বানাত। আমি সেই বয়সেই খুব তাড়াতাড়ি চটে যেতাম বা বিরক্ত হতাম এবং সেটা প্রকাশও করতাম। সেজন্যই হয়তো আমাকে প্রায়ই টার্গেট করে খাউরি বানানো হতো। ১৯৪১ সালে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এ সম্বন্ধে বিস্তৃত বলতে হবে। ৭ আগস্ট আমরা সহসা অবহিত হলাম যে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরলোকগমন করেছেন। তাকে শুভ্র, লম্বা চুল ও শ্মশ্রুম-িত পীর-দরবেশের মতো কবি বলে আমরা চিনি। তার ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতা আমাদের পাঠ্যবইতে আছে। আমরা শুনলাম যে, তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন। আরও শুনলাম যে, তিনি বিশ্বখ্যাত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম প্রাচ্যদেশীয় ব্যক্তি। ছুটি পেয়ে আমরা বাড়ি এসে পৌঁছলাম। এসে দেখি সেখানেও আমাদের জন্য রয়েছে বিস্ময়। আমরা স্কুলে যাবার পর আমাদের একটি ফুটফুটে ভাই জন্ম নিয়েছে। আমাদের মা যে আরও একটি সন্তানকে জন্ম দেবেন সে সম্বন্ধে আমাদের দু’ভাইয়ের কোন ধারণাই ছিল না। চিন্তা করে দেখুন আমরা তখন কত নির্বোধ ছিলাম। এখন ৭/৯ বছরের একটি ছেলে তার যে একটি ভাই বা বোন অচিরে জন্ম নিতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে যত জ্ঞান রাখে, তার এতটুকুও আমাদের তখন ছিল না। আমার ভাই সুজনের (আবু সালেহ আবদুল মুয়িজের) জন্মের সঙ্গেই বোধ হয় আমার শৈশবের অবসান হয় এবং আমি কৈশোরে পদার্পণ করি। পঞ্চম শ্রেণীতে যখন পড়ি তখন একদিন আমার বন্ধু আহমদ কবীর চৌধুরীর (জগলুল) সঙ্গে ঝগড়া করে গালাগালি শুরু করি। গালাগালির জানা শব্দ যখন শেষ হয়ে গেল তখন ভৌগোলিক শব্দ নিয়ে গাল দিতে থাকি। কয়েকবারই ঊড়িষ্যা শব্দ ব্যবহার করি। পরের দিনই আমি হয়ে গেলাম খাউরি আর সেজন্য আমাকে চটানো হতো উড়িষ্যা বলে। আমার বড় চাচা আবদুল মতিন যখন আসাম সরকারে গণপূর্ত বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী তখন তার বিয়ে হলো ১৯৪৩ সালে। বিয়ের কিছুদিন আগে তিনি একটি পুরনো ফোর্ড গাড়ি কিনতে আগ্রহী হন। সে জন্য তার নিজের সামর্থ্যরে অতিরিক্ত আরও দু’হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। আমার দাদা তাকে সেই অর্থ প্রদান করেন। তবে দাদা তার হিসাব ঠিকই রাখেন। তিনি যখন অন্য সন্তানদের জমি বা বাড়ি দান করেন তখন এই ছেলেকে কোন জমি দিলেন না। আমার চাচার গাড়িটি ছিল শহরের অন্যতম আকর্ষণ, কারণ তাতে সেলফ স্টার্টার ছিল। এই গাড়িটি এক বিয়ে বাড়িতে একদিন পার্ক করা ছিল। গাড়ির চালক রোহিনী গোস্বামী কিছু সময়ের জন্য গাড়িতে ছিল না। আমি সেই ফাঁকে গাড়িটি স্টার্টের বোতামে টিপে দিই। গাড়িটি সশব্দে স্টার্ট দিয়েই বন্ধ হয়ে যায়। রোহিনী বাবু আওয়াজ শুনে এসেই আমাকে এমন এক ধমক দেয় যে, আমি তখন পালাতে পারলে বেঁচে যাই। গাড়ি চালানোর এই প্রথম উদ্যোগ আমি কোনদিনই ভুলিনি। গাড়ি চালানোয় ভবিষ্যতে আমার আরও তিক্ত অভিজ্ঞতার অভাব ছিল না। আমাদের সময়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় লাহোরে গাড়ি চালানো শিক্ষা দেওয়া হতো। সে শিক্ষাটি পূর্ণ হলো না বৃষ্টির কারণে। ১৯৫৭ সালের বসন্তে লাহোরে এত বৃষ্টি হয় যে, আমাদের গাড়ি চালনায় প্রশিক্ষণ স্থগিত করতে হয়। ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ডে আমি রীতিমতো ফিস দিয়ে গাড়ি চালানো শিখলাম, শিক্ষানবিশের লাইসেন্সও নিলাম; কিন্তু প্রথমবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। শীতের ছুটিতে আমরা কয়েক বন্ধু একটি গাড়ি করে স্কটল্যান্ড ভ্রমণে গেলাম। ঐ গাড়িটি কিছু সময়ের জন্য আমাকে চালাতে হয়। আমি তাতে এতই ইতস্তত করি যে, একটি চৌমাথায় বিরাট যানজট সৃষ্টি করে বসি। আমি বেখেয়ালীভাবে একটি লাল বাতি দেখেও গাড়ি চালাতে থাকি। প্রথমে নানা দিক থেকে গাড়ির হর্ন আমাকে অপদস্থ করতে থাকল। তারপর পুলিশ এসে যানজটের নিরসন করল। এর পরে গাড়ি চালানোতে আমার এমন একটি ভীতির সঞ্চার হয় যে, পরবর্তী তিন বছর আমি কখনও গাড়ি চালাতে সাহস করিনি। ১৯৬১ সালের শেষ লগ্নে আমি ১৯৫৭ সালের পর প্রথম একদিন গাড়ি (জিপ) চালিয়ে বেইলি রোড থেকে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে যাই আমার আব্বাকে সিলেটের ট্রেনে স্বাগত জানাতে। কিন্তু আমার ভীতি তাতেও গেল না। অবশেষে ১৯৬৫ সালে যখন করাচীতে ছিলাম তখন থেকেই গাড়ি চালনায় আমার স্বাচ্ছন্দ্য আসে। অবশ্য, প্রথম দিকে আমি পাশে রাখতাম একজন অভিজ্ঞ গাড়িচালককে। পাকিস্তানে করাচী, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, পেশাওয়ার, মারী, নথিয়াগিলি, এবোটাবাদ ঘুরে ঘুরে গাড়ি চালানোতে অবশেষে দক্ষতা ও স্বাচ্ছন্দ্য হাসিল করি; পাহাড়ী পথে গাড়ি চালনায় আমার বিশেষ দক্ষতা ছিল। আমাদের বাড়ির প্রায় পেছনেই ছিল ধুবড়ী হাওড় নামক জলাভূমি। শীতকালে এই এলাকাটির পানি নিচে চলে যেত বলে এটি একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে পরিণত হতো। বর্তমানে চালিবন্দরের পশ্চিমে যে নি¤œভূমি আছে এবং সুপানিঘাটের পুলিশ ফাঁড়ির সঙ্গে সংলগ্ন যে দোকানপাট ও শাহজালাল আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে এসবই ছিল ধুবড়ী হাওড়ের অন্তর্ভুক্ত। এখানে জনবসতি ছিল অতি কম। আমরা বলতাম যে, হাওড়ের মাঝে ২/৪টি দ্বীপ পাওয়া যায় এবং সেই দ্বীপেই শুধু জনবসতি আছে। বর্ষাকালে এ এলাকায় যেতে হতো নৌকায় চড়ে। এই ধুবড়ী হাওড়ে হেমন্ত থেকেই পানি নেমে যেত এবং পুরো হাওড়টি হতো একটি উন্মুক্ত ময়দান। এই ময়দানে প্রায় প্রতি বছর মেলা বসত। ‘ময়দানের একটি এলাকায়’ ‘ঘুড়ি উৎসব’ পালিত হতো। এই উৎসবে বিভিন্ন ব্যক্তি বা দল নানা ধরনের ঘুড়ি বানাত এবং যে সুতায় ঘুড়িকে উড়ায় সেই সুতাকে নানাভাবে জোরালো করা হতো। ঘুড়িতে ঘুড়িতে কাটাকাটি খেলা হতো। যার সুতা যত ভাল বা ধারালো সেই অন্য ঘুড়ির সুতা কেটে দিত এবং খেলাটি সেখানেই শেষ হয়ে যেত। কে কত বেশি ঘুড়ি কাটতে পারত সেটি ছিল একটি কৃতিত্বের বিষয় এবং তখন সবাই খোঁজ নিত তার সুতাকে কিভাবে সে শক্তিশালী করেছে। ঘুড়ির সুতাকে জোরদার করার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো তাকে বলত সুতায় ‘মানজা’ প্রদান।’ তাতে নানা উপাদান থাকত, যার প্রধানটি ছিল পানি দিয়ে সিদ্ধ করা ময়দার গোলা। ধুবড়ী হাওড় এলাকায় শীতকালে মেলা বসত এবং সেখানে অন্তত ১০/১৫ দিন লোকে লোকারণ্য থাকত। আমরাও মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম এবং আমাদের সঙ্গী থাকতেন হয় মেজো মামা সৈয়দ শাহাদত হোসেন, না হয় ছোট মামা সৈয়দ শাহ আনোয়ার চৌধুরী। মেজো মামা ছিলেন আম্মার ফুপাতো ভাই। এরা দু’জনেই অল্প বয়স থেকে আমাদের বাড়িতে থাকতেন এবং স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতেন। মেজো মামা বিএ পাস করে ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। ছোট মামা ১৯৪৮ সালে প্রবেশিকা পাস করে সিলেটের মেডিক্যাল স্কুল থেকে চার বছরে ডাক্তারী খরপবহঃরধঃব (লাইসেনসিয়েট) হন। সে সময় লাইসেনসিয়েটরাও ডাক্তারী করতে পারতেন। কয়েক বছর পর লাইসেনসিয়েটদের ডাক্তারী গ্র্যাজুয়েট হবার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং তারা আরও দু’বছর পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার হতে পারতেন। আমার ছোট মামা এই নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর একজন গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার হন। ছোট মামা ডাক্তার হওয়ার পরেও কিছুদিন আমাদের সঙ্গে অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি স্বতন্ত্র বাসস্থানে চলে যান এবং তার ডাক্তারী কার্যক্রম চালিয়ে যান। ধুবড়ী হাওরে শীতকালে প্রায়ই ঘোড় দৌড় অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে তেমন বাজি রাখার সুযোগ ছিল না, যদিও দৌড়ে যারা ভাল করত তাদের সম্মান দেয়া হতো এবং সম্ভবত টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। আমার কৈশোরে বিভিন্ন নতুন জায়গা ভ্রমণের সুযোগ খুব কম ছিল। আমরা প্রায় প্রতি বছর ঘটা করে নানা বাড়ি যেতাম। সুনামগঞ্জের সৈয়দপুর ভ্রমণে বর্ষাকালে লাগত প্রায় একদিন এবং শীতকালে নানাভাবে ভ্রমণ করে (বাস অথবা ট্যাক্সিতে কিছুটা, পায়ে হেঁটে কিছুটা এবং নৌকায় চড়ে কিছুটা) লাগত প্রায় ছয় ঘণ্টা। এছাড়া আমরা প্রায়ই সিলেট থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত ফুলবাড়ি যেতাম মোটরগাড়ি করে অথবা বাসে চড়ে। ফুলবাড়িতে ছিলেন আব্বার একজন মক্কেল এবং বন্ধু মহবুবুল কাদির চৌধুরী (ডাক নাম মুবই মিয়া)। তাদের বাড়িটি ছিল একটি সুন্দর টিলার ওপর এবং প্রথম দিকে একই বাড়িতে কয়েক পরিবারের বাসস্থান ছিল, যারা ছিলেন নিকটাত্মীয়। পরবর্তীতে অবশ্য তারা বিভিন্ন পরিবার তাদের নিজেদের বাড়ি স্বতন্ত্র টিলায় স্থাপন করেন। আমরা মুবই মিয়াকে ফুলবাড়ির চাচা বলে ডাকতাম এবং কৈশোরে আমাদের ধারণা ছিল যে, তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ফুলবাড়ির চাচার ছেলে দু’জন আমাদের বাড়িতে থেকে স্কুলে পড়াশোনা করেছে। আমার বয়সের ভাইটি অল্প বয়সেই (খালন) মৃত্যুবরণ করে। ছোটটি মতি ওরফে মাহবুবুল খালেক চৌধুরী এখন আমাদের সিলেটের বাড়িতেই থাকে এবং সেটি দেখাশোনা করে। নানাবাড়ি এবং ফুলবাড়ি ছাড়া আর একটি এলাকায় কৈশোরে আমরা দু’ভাই ভ্রমণ করি। সেটি ছিল দিরাই থানা। সেখানে জাহাজে চড়ে এক বর্ষাকালে আমরা যাই। কারণ, তখন দিরাইয়ের স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন আমার বড় মামা। দিরাই এলাকায় ছিল কয়েকটি দ্বীপ। নৌকায় করে এসব দ্বীপে যেতে হতো, তবে হেমন্ত ও শীতকালে সব দ্বীপ মিলেই ছিল দিরাই থানার জনপদ। চলবে...
×