ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বালি উত্তোলন বন্ধ করাও প্রয়োজন

যমুনা ভাঙ্গন রোধে ॥ ড্রেজিং জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

যমুনা ভাঙ্গন রোধে ॥ ড্রেজিং জরুরী

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর, ১৭ অক্টোবর ॥ যমুনা নদীর ভাঙ্গন রোধে নদী থেকে ট্রাক ও ড্রেজার দিয়ে অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধসহ নদীতে বালির বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক নেটিংয়ের পাশাপাশি নদীর গভীরতা বাড়াতে যমুনার মূল স্রোতধারায় ড্রেজিং করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ি উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনার বাম তীরে দুই যুগ ধরে ভয়াবহ নদীভাঙ্গন চলছে। এতে ইসলামপুরের উলিয়া ও গুঠাইল এলাকার পশ্চিমে ১৩ কিলোমিটার প্রশস্তের যমুনা নদীতে চর আর চরের পর এবং অসংখ্য ছোট-বড় নদীর সৃষ্টি হয়েছে। বিগত দুই যুগে যমুনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে ইসলামপুরের সাপধরী ইউনিয়নটি নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। ওই ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে এখন যমুনার বুকে জেগে ওঠা নতুন চরে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে আছে। এছাড়া নদীভাঙ্গনের শিকার হয়েছে ইসলামপুরের পাথর্শী, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা ও চিনাডুলি ইউনিয়নের আরও অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। তাদের বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঠসহ ওই সব ইউনিয়নের ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার ও বহু রাস্তাঘাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙ্গা ওই মানুষগুলো ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়ে যমুনার চরে অথবা রাস্তার ধারে ও যমুনার চরাঞ্চলে ঝুপড়ি বেঁধে জীবনযাপন করছে। অনেকেই এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরের বস্তিতে। আরও জানা গেছে, নদীভাঙ্গন ঠেকাতে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন সরকার ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনার বাম তীরে ইসলামপুরের কুলকান্দি পয়েন্টে কুলকান্দি রিভেটমেন্ট টেস্ট স্ট্রাকচার নির্মাণ করে। এর কয়েক বছর পর ইসলামপুরের গুঠাইল বাজার এলাকায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ড পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়। এছাড়া যমুনার ভাঙ্গন রোধে ইসলামপুরের উলিয়া বাজার এলাকায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ এবং ইসলামপুরের নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের হাড়গিলা এলাকায় নদীতে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সবশেষে যমুনার বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছর ধরে নদীতে বালির বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক নেটিং করছে। এ ডাম্পিং কার্যক্রম নদীভাঙ্গন ঠেকাতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, উল্টো বিগত দিনে নির্মিত কংক্রিটের বাঁধও নদীভাঙ্গন ঠেকাতে পারেনি। ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম জানান, আগামী শুষ্ক মৌসুমে যমুনার ভাঙ্গন রোধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় খুব শীঘ্রই ইসলামপুরের শতবছরের ঐতিহ্যবাহী গুঠাইল হাট-বাজার, গুঠাইল হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ ও গুঠাইল সিনিয়র মাদ্রাসাসহ আশপাশের দুই সহস্রাধিক বসতভিটা ও ফসলি জমি যমুনাগর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইসলামপুরের সাপধরী ইউনিয়নের নদীভাঙ্গনের শিকার অসহায় কৃষক আনছার আলী, আজাহার ম-ল, কমল প্রামাণিক, হেলাল উদ্দিন, মোকারম হোসেনসহ কুলকান্দি, সাপধরী, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা ও চিনাডুলি ইউনিয়নের শত শত কৃষকের অভিযোগ, যমুনায় অপরিকল্পিতভাবে বালির বস্তা ডাম্পিং করার নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছরই সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করলেও নদীভাঙ্গন রোধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা আরও জানান, আজ থেকে প্রায় দুই যুগ ধরে যমুনার বাম তীরের অব্যাহত ভাঙ্গন ঠেকাতে জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কয়েকজন ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রায় প্রতি বছরই নদীভাঙ্গন এলাকায় নামমাত্র বালিভর্তি বস্তা ও সিসি ব্লক ডাম্পিং করে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও নদীভাঙ্গন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসলামপুরের কুলকান্দি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জুবাইদুর রহমান দুলাল আক্ষেপ করে বলেন, যমুনায় বালির বস্তা ফেলে কী হইব? নদীভাঙ্গন তো থামে না। আগের বছর বস্তা ফেললে পরের বছরই তার কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রায় ১৫ বছর ধরে যমুনার বাম তীরে বালির বস্তা ডাম্পিং করা হচ্ছে। আবার নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনেরও মহোৎসব চলছে। এতে নদীভাঙ্গন ঠেকাতে বস্তা ডাম্পিং কোন কাজেই আসছে না। রাক্ষুসী যমুনার পেটে সরকারের টাকায় বালির বস্তা ফেলে কেবল অফিসার আর ঠিকাদারদের পেট ভরানো হচ্ছে। এটা কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, নদীভাঙ্গন রোধে বালির বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক নেটিংয়ের পাশাপাশি যমুনার মূল স্রোতের লাইনে হঠাৎ জেগে ওঠা নতুন চর অপসারণ ও নদীর গভীরতা ঠিক রাখতে নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, যমুনা নদীতে ড্রেজিং না করে শুধুমাত্র বালির বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক নেটিং কর্মসূচী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আর যমুনার তীর থেকে অবৈধভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট বালি উত্তোলন বন্ধ না করা প্রশাসনের ব্যর্থতা। এসব ব্যর্থতার কারণে নদীভাঙ্গন রোধে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানান, যমুনার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেওয়ানগঞ্জের ফুটানী বাজার, ইসলামপুরের পশ্চিম বামনা ও শিংভাঙ্গা এলাকায় যমুনার বাম তীরে বালির বস্তা ডাম্পিং ও ব্লক সেটিং চলছে। যমুনা নদীর ভাঙ্গন রোধে বালির বস্তা ডাম্পিং ও ব্লক সেটিং পাউবোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা নয়। তবে ডাম্পিং পয়েন্টের উজানে কোন প্রটেকশন না থাকায় ইসলামপুরের গুঠাইল ও কদমতলী এলাকায় ডাম্পিং করা বালির বস্তা বিগত বন্যায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইসলামপুরের উলিয়া, চিনাডুলি, গুঠাইল ও বেলগাছা এলাকায় যমুনার ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
×