ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈদেশিক সাহায্য বরং ক্ষতির...

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

বৈদেশিক সাহায্য বরং ক্ষতির...

বৈদেশিক সাহায্য গরিব দেশগুলোর গরিব লোকদের প্রায়শ ক্ষতির মুখোমুখি করে, এমন কথা উদ্ভট মনে হতে পারে। তবে এই কথাই বলেছেন এবারের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ এ্যাঙ্গাস ডিটন। প্রিন্সটন ইউনির্ভাসিটির এই অর্থনীতিবিদ ইন্ডিয়া এবং আফ্রিকার দরিদ্রতার ওপর কাজ করেছেন। কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাংকে কাজ করা এই অর্থনীতিবিদ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিভাবে গরিবরা অর্থ সঞ্চয় কিংবা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সে বিষয়ে গবেষণার জন্য। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে তাঁর মতবাদ অনেকটাই তর্কোদ্দীপক। ডিটন বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর গরির মানুষদের সাহায্যের চেষ্টা করতে গিয়ে ধনী দেশগুলো আদৌতে ঐ দেশগুলোর সরকারগুলোকে দুর্নীতিপরায়ণ হতে সাহায্যে করে এবং তাদের প্রবৃদ্ধির গতিকে ধীর করে দেয়। ডিটন এবং তাঁর অনুসারীরা দেখিয়েছেন যে, ২০১৪ সালে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক সাহায্য উন্নত দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে দিয়েছে তা আদৌতে গরিবদের তেমন সাহায্য করেনি। ষাটের দশকের শেষের দিকে তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার বায়ফ্রা অঞ্চলের শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, এমন দৃশ্য আমেরিকার টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে সে দেশের সাধারণ মানুষ নিক্সন প্রশাসনের কাছে ঐ অঞ্চলে সাহায্যে পাঠানোর দাবি করে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে নিক্সন প্রশাসন বিমানে করে প্রচুর ত্রাণ ঐ অঞ্চলে পাঠিয়েছিল। এটাই ছিল প্রথম বড় রকমের কোন বৈদেশিক সাহায্যে। মানবিক এই সাহায্যই যুদ্ধ ছাড়াই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন আশা জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে গরিব দেশগুলোকে সাহায্যে করা নিয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিতর্কও শুরু হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদই বিশ্বাস করত যে, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হলো ইতোমধ্যে ধনী দেশে পরিণত হওয়া কিংবা ধনী দেশে পরিণত হতে চায়, এমন দেশগুলো তাদের অর্থ অন্য দেশগুলোর কারখানা, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা। তাই দেখা যায়, পশ্চিমা মডেলের গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি বিস্তারের জন্য আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপিয়ান শক্তি ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশগুলোতে বৈদেশিক সাহায্য দিতে থাকে। এর বিশেষ কারণ ছিল ঐ দেশগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখা। ষাটের দশকের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সাহায্য দেয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় যা ¯œায়ুযুদ্ধ শেষে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। এরপর এর পরিমাণ কমে গেলেও আবারও বাড়তে থাকে। একদিকে লাইভ মিউজিক কনসার্টের মাধ্যমে সাহায্য তুলে আফ্রিকার ক্ষুধার্তপীড়িত মানুষদের সাহায্যে পাঠান শুরু হয়। আবার অন্যদিকে আমেরিকা মাল্টি বিলিয়ন ডলারের সাহায্যে প্যাকেজ গ্রহণ করে ও বিশ্বব্যাংক এবং এইড পরামর্শদাতারা বলতে শুরু করে, বৈদেশিক সাহায্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করছে। ডিটনই প্রথম কোন অর্থনীতিবিদ নন, যিনি এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তবে বিগত দুই দশক ধরে দেয়া তাঁর বক্তব্য মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বৈদেশিক সাহায্যে আদৌতে গরিবের কোন উপকারে আসে না। তাঁর বিশ্লেষিত উপাত্তে দেখা যায় আশি ও নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকায় বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে গিয়েছিল। যেসব দেশ বেশি বৈদেশিক সাহায্যে গ্রহণ করেছিল সেসব দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক গতি প্রবাহ সৃষ্টি হয়নি। যেসব দেশ তুলনামূলক কম বৈদেশিক সাহায্যে গ্রহণ করেছিল, তাদের থেকে গ্রহণকারী দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক কম। কেন এমনটা হয়েছে? এর জবাব দেয়া এত সহজ নয়। তবে ডিটন ও তাঁর অনুসারীরা বলছেন, বৈদেশিক সাহায্যে সেদেশগুলোর সরকার ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ককে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সরকার পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ সরকার জনগণের কাছ হতে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করে থাকে। এজন্য সরকারও নাগরিকদের প্রতিজ্ঞানুযায়ী মৌলিক সেবা প্রদান করে থাকে। না হলে, জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যে এই সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়। কেননা সরকার তখন জনগণের প্রতি তেমন দায়বদ্ধ থাকে না। এটা খুবই অদ্ভুত যে, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে যেমন তেল ও হীরায় পরিপূর্ণ দেশগুলোই বেশি দরিদ্র ও অনুন্নত। ডিটনের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে দেশগুলো খনিজ ও ধাতব পদার্থে পরিপূর্ণ সে দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক সম্পদ বিদ্যমান দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির গতি ভাল। অর্থনীতিবিদরা একে প্রাকৃতিক সম্পদের অভিশাপ বলে থাকে। আসলে এর কারণ এসব সম্পদ সরকারগুলোকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। প্রাকৃতিক সম্পদের মতোই বৈদেশিক সাহায্যে দুর্বল সরকারগুলোকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। ডিটন তাঁর ‘দ্য গ্রেট এসকেপ: হেলথ, ওয়েলথ এ্যান্ড দ্য অরিজিনস অব ইনইকুয়্যালিটি’ গ্রন্থে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। উদাহরণ হিসেবে ডিটন জায়ারে, রুয়ান্ডা, ইথোপিয়া, সোমালিয়া, বায়াফ্রা এবং কম্বোডিয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এই দেশগুলোতে বৈদেশিক সাহায্যে আসলে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, আমেরিকা জনকল্যাণে বৈদেশিক সাহায্যে দেয়ার পরিবর্তে বাণিজ্যিক সুবিধা, রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনা করে বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে থাকে। আমেরিকা ইথোপিয়ার স্বৈরশাসক মেলেস জেনাউয়ি আসরেজকে কয়েক দশক ধরে সাহায্য দিয়েছে। কেননা সে ইসলামী মৌলবাদীদের বিরোধী ছিল। কিন্তু সে যে আফ্রিকার এক নির্যাতনকারী স্বৈরশাসক তা আমেরিকা ধর্তব্যর মধ্যে আনেনি। গরিব দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য অর্থের চেয়েও সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরী তা হলো সুশাসন। অনেক সময় সুশাসন বৈদেশিক সাহায্যের কারণে বিঘিœত হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে, ডিটনের বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে সমালোচনা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। বৈদেশিক সাহায্যে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটাই হলো আসল ব্যাপার। বৈদেশিক সাহায্যে যদি স্থানীয় বাণিজ্যে অর্থায়ন, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন কিংবা জনগণের শিক্ষাসহ অন্যান্য জনকল্যাণ খাতে ব্যয় করা হয়, তবে সেদেশগুলোর জনগণ উপকৃত হয়। গত দশক থেকে গবেষকরা বৈদেশিক সাহায্যে কে এসব খাতে ব্যয় করতে বলে আসছে। ডিটনও অবশ্য বৈদেশিক সাহায্যে যেগুলো জনকল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে, তার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যে নির্ভর জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো সর্বত্র কাজ করছে না। এ বিষয়ে ডিটন বলেন, সমস্যা হলো বৈদেশিক সাহায্যে নির্ভর জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো কেনিয়াতে কাজ করলেও এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই যে এটা ইন্ডিয়া কিংবা নিউজার্সিতে কাজ করবে। এ সব ক্ষেত্রে স্থানীয় অনেক উপাদানই প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ডিটন আসলে বৈদেশিক সাহায্যে কিভাবে অপব্যহার হয়, সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। ডিটন সবধরনের বৈদেশিক সাহায্যেরই যে সমালোচনা করেছেন, এমনটা নয়। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বাস্থ্যখাতে বৈদেশিক সাহায্যে যেটা টিকা কিংবা স্বল্পমূল্য ওষুধ বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আসলে বৈদেশিক সাহায্যের খুব অল্পই জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়, এমনকি অনেক সময় জনবিরোধী কাজেও এই অর্থ ব্যয় করা হয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত বলে ডিটন মনে করেন। মিলিয়ন মিলিয়ন গরিব লোকদের উন্নতির কথাই সর্বাগ্রে বিবেচনা করা উচিত। অস্ত্র ক্রয়ের জন্য সাহায্যের পরিবর্তে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে বৈদেশিক সাহায্যে কাজে লাগানো হলে সেক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যে যে অপ্রয়োজনীয় তা মনে হবে না। ডিটন মনে করেন বৈদেশিক সাহায্যে দিয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যা উপনিবেশের সঙ্গে তুল্য। গরিব দেশের মানুষজনকে সভ্য ও আলোকিত করে তোলার পরিবর্তে বৈদেশিক সাহায্যে অনেকটা শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডিটন দেখিয়েছেন যে, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এগুলো বৈদেশিক সাহায্যে নির্ভর নয়। বরং যেসব উন্নয়নশীল দেশ বিশেষ করে চীনের মতো দেশগুলো যারা কম বৈদেশিক সাহায্য নিয়েছে সেসব দেশেই বেশি উন্নয়ন ঘটেছে। বৈদেশিক সাহায্যের নামে কোন কিছু চাপিয়ে দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য ডিটনের অভিমত, গরিব দেশগুলোকে তাদের মতো করেই উন্নত হতে দেয়া উচিত। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট
×