ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিশু নির্যাতনকারীরা ছাড় পাবে না, বিচার তাদের হবেই ॥ প্রধানমন্ত্রী

ছোট্ট রাসেলকে হারানোর বেদনায় প্রধানমন্ত্রী কাঁদলেন, কাঁদালেন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

ছোট্ট রাসেলকে হারানোর বেদনায় প্রধানমন্ত্রী কাঁদলেন, কাঁদালেন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ছোট ভাই শেখ রাসেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্র ১১ বছরের শিশু রাসেলের বড় হওয়ার গল্প আর নির্মম হত্যাকা-ের বর্ণনা শুনে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে পুরো মিলনায়তনে, উপস্থিত শত শত শিশু-কিশোরের চোখ বেয়ে গড়ে পড়ছিল অশ্রু। প্রধানমন্ত্রী রবিবার ছোট ভাই শেখ রাসেলসহ স্বজন হারানোর বেদনায় যেমন কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন সবাইকে। ‘আজ রাসেলের জন্মদিন। এই দিনেই আলো করে এসেছিল, আমার ছোট্ট ভাইটি। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। সবচেয়ে ছোট রাসেল। রাসেল আমাদের নয়নের মণি ছিল। রাসেল এখন বেঁচে থাকলে ৫১ বয়সের হতো। চিন্তা করি, কেমন হতো সে দেখতে...। আমি এখনও বুঝতে পারি না, কি অপরাধ ছিল শিশু রাসেলের?’ বলতে বলতে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে বড় বোন শেখ হাসিনার কণ্ঠ। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবেগে জড়িয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী ‘প্রত্যেক শিশুর নিরাপদ আবাস’ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, পঁচাত্তরের কালরাতে ঘাতকের বুলেট নিষ্পাপ শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। তাকেও কেড়ে নিয়েছে। আর যেন কোন শিশুর ভাগ্যে এমন ঘটনা না ঘটে সেটাই আমাদের কাম্য। সে জন্য প্রত্যেক শিশুর নিরাপদ বাসযোগ্য দেশ গড়ে তুলতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমি চাই বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু সুন্দরভাবে বাঁচবে, উন্নত জীবন পাবে। তাদের জীবন সুন্দর হবে এবং এই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজকে যারা শিশু, আগামী দিনে বড় হয়ে তারাই তো নেতৃত্ব দেবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শিশু নির্যাতনকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, খুব খারাপ লাগে যখন দেখি আমাদের দেশে অনেক সময় বাড়িতে শিশুদের নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকারীরা কী মানুষ? যারা শিশুদের ওপর নির্যাতন করে বা শিশুদের হত্যা করে তাদের বিচার আমরা করবই ইনশাআল্লাহ। তারা ছাড়া পাবে না। যে-ই করবে তার বিচার আমরা করব। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শিশু নির্যাতন প্রসঙ্গে আরও বলেন, গরিব ঘরে জন্ম হওয়াÑ সেটাই কি অপরাধ? একটা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে আসে কাজ করাতে। আর তার ওপর অত্যাচার, মারধর করে। নিজের যে সন্তান, নিজের যে শিশু, তাদের কথা মনে করে না? এসব শিশুরও তো অধিকার আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দেখি একটা ঘটনা ঘটে, সে ঘটনা এরপর ব্যাপকহারে ঘটার একটা প্রবণতা। ঠিক জানি না, এটা বাংলাদেশের মানুষের চরিত্রের কোন একটি দিক কি না। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, এই ধরনের শিশু নির্যাতনের ঘটনা কেউ যেন না ঘটায়। কেউ যেন এই ধরনের মানবতাবিরোধী কাজ না করে। এসব যেন বন্ধ হয় সবাইকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু, শেখ রাসেলসহ আমার পরিবারের ১৮ সদস্যকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ২১ বছর এই হত্যাকা-ের বিচার হয়নি, আইন করে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা ক্ষমতায় এসে জাতির জনকের হত্যার বিচার শুরু করি এবং রায় কার্যকর করে দৃষ্টান্ত রেখেছে যে কেউ হত্যা করলে তাকে নির্যাতনের মুখোমুখি হতেই হবে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। এসব জঘন্য অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাই, যেখানে শিশুরাও নিরাপদ থাকবে। আর যে কোন শিশুকে ভাগ্যে শেখ রাসেলের পরিণতি না আসে। সমাজের অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের অবহেলা না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুযোগ দেয়া হলে এই শিশুরাও দেশের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। আমরা বাংলাদেশকে প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি শিশুকে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সে জন্য উপযুক্ত পড়াশোনা করতে হবে। সে লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করছে। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রকিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, সংগঠনের মহাসচিব মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এমপি, মোজাহিদুর রহমান, কে এম শহীদুল্লাহ এবং মুজিবুর রহমান হাওলাদার বক্তব্য রাখেন। শিশু-কিশোরদের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয় আতিকা সাইয়ারা। আলোচনা পর্ব শেষে রচনা, চিত্রাঙ্কন ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ এবং সবশেষে শিশুদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও দর্শক সারিতে বসে উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তব্যের শুরুতেই শেখ রাসেলের ছেলেবেলায় বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জন্মের পর থেকে শুনেছি, আমার বাবা জেলে। রাসেলের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়নি। রাসেল যখন দেড় বছরের, ৬৬ সালের মে মাসে আমার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন রাসেল কিছু বুঝত না। আধো আধো কথা বলত। বাবাকে খুঁজে বেড়াত। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি আরও বলেন, জেলখানায় যেদিন আব্বার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, রাসেল ফিরতেই চাইত না। যেদিন দেখা করে আসতাম, সেদিন রাতে হয়ত ঘুমাতই না। আবার কয়েকদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কান্নাজুড়ে দিত। আমি, কামাল, রেহানাসহ সকলে তাকে ঘিরে বসে থাকতাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাসেল বলতে পারত না- কী তার ব্যথা। এভাবেই রাসেল বড় হয়। আরেকটু বড় হলে রাসেল মনে করল বাবা ওখানেই (কারাগার) থাকবে, ওটাই তাঁর বাড়ি। মাঝে মাঝে জিদ ধরত বাবাকে জেলখানা থেকে নিয়ে আসবে। বাবার জন্য রাসেলের মনটা আকুলি-বিকুলি করত। তাই সে এক সময় আমার মাকেই আব্বা আব্বা বলত। ওই ছোট্ট শিশুটা বুকে কত ব্যথা নিয়ে ছিল। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এখনও বুঝে পাই না কী অপরাধ ছিল তাদের। বঙ্গবন্ধু তো দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আজ আমাদের রাষ্ট্র আছে, সম্মান আছে। বঙ্গবন্ধু যদি সংগ্রাম না করতেন, বছরের পর বছর জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য না করতেন, আমরা স্বাধীনতাই তো পেতাম না। তিনি বলেন, আমরা দু’বোন দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলাম। অনেকে হয়ত মনে করেন, আমরা বেঁচে আছি বলেই দেশের জন্য কিছু করতে পারছি। কিন্তু আপনজন হারিয়ে বেঁচে থাকাটা, বাবা-মা, ভাই হারিয়ে এই বেঁচে থাকাটা যে কত কষ্টের, সেটা আমি ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকের কাছ থেকে সবাইকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের ঠাঁই হবে না। আমার দেশে যেন কোন রকম জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসের স্থান না হয়, মাদকাসক্ত হয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন তাদের জীবনটাকে নষ্ট না করে সে জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক শিশুকে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবা-মা, অভিভাবক, শিশু প্রত্যেককে বলব প্রতিটি শিশুকে পড়াশোনা করতে হবে। লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। কারণ লেখাপড়া ছাড়া, জ্ঞানার্জন ছাড়া কখনও নিজেকে গড়ে তোলা যায় না। শিশুদের খেলাধুলা, সংস্কৃতি, সাহিত্য চর্চার ওপরও গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমি আমার ছোট ভাইটিকে হারিয়েছি। কিন্তু চাই প্রতিটি শিশুর জীবন যেন নিরাপদ হয়। যে অকালেই ঝরে গেছে, ফুল ফোটার আগেই যে শিশু ঘাতকের গুলির আঘাতে ঝরে গেছে- আমাদের শিশুদের মধ্যেই আমার সেই রাসেলকে খুঁজে পাই। তোমরা সবাই আমার কাছে এক একজন রাসেল।
×