ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেয়াল ভাঙ্গার দেয়াল পত্রিকা

ক্ষুদে লেখক সম্পাদকদের চিন্তার জগত, কচিকাঁচা মনের সৃজনশীলতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

ক্ষুদে লেখক সম্পাদকদের চিন্তার জগত, কচিকাঁচা মনের সৃজনশীলতা

মোরসালিন মিজান কত কত বাধার দেয়াল এখন! প্রতিদিন ওঠছে। ওঠছেই শুধু। সে তুলনায় দেয়ালপত্রিকা কম। দেয়াল ভাঙার দেয়ালপত্রিকা কখনও সখনও চোখে পড়ে। তবে হারিয়ে যায়নি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়েও মাধ্যমটি ব্যবহার করে প্রকাশ করা হচ্ছে কচিকাঁচা মনের ভাব। চারপাশের পরিবেশ, প্রতিবেশ, মনোজগৎতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, আগামীর স্বপ্ন- সব ফুটে ওঠছে দেয়ালপত্রিকায়। লেখার বিষয়ে যেমন বৈচিত্র্য, তেমনি শৈল্পিক উপস্থাপনা। গত কয়েকদিন ধরে চলা দেয়ালপত্রিকা উৎসব ঘুরে এমন ধারণা হলো। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় চার দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ দেয়ালপত্রিকা পরিষদ। এর আগে আয়োজনটি করা হতো বাংলা একাডেমির দেয়াল ঘেরা চত্বরে। এবার সেটি স্থানান্তর করা হয় সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের খোলা প্রাঙ্গণে। ফলে আরও প্রাণ পায়। ঢাকা ছাড়াও ১৪ জেলার প্রায় ১৬৬টি স্কুল এতে অংশ নেয়। ক্ষুদে লেখক সম্পাদকদের মিলনমেলা রবিবার শেষ হয়েছে। সমাপনীর আগের মুহূর্তটি পর্যন্ত গোটা এলাকা ছিল দেয়ালপত্রিকায় একরকম মোড়ানো! উৎসবের বিভিন্ন দিনে গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে তাদের দেয়ালপত্রিকাগুলো প্রদর্শন করছে। এসবে নিজেদের গল্প কবিতা ছড়া যেমন আছে, তেমনি আছে বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা। নারী নির্যাতন শিশু নির্যাতনসহ অমানবিক সকল কর্মকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হচ্ছে। প্রত্যাশা করা হয়েছে মানবিক পৃথিবী। গঠন, আকার ও আকৃতির দিক থেকেও দেয়ালপত্রিকাগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। উৎসবে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একাধিক শাখা অংশগ্রহণ করে। মূল শাখাটির কথা আলাদা করে বলতে হয়। ছাত্রীরা তাদের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এক কথায় দারুণ উপস্থাপনা। দেয়ালপত্রিকার এক কোনে আলাদা করে একটি বই সংযুক্ত করা হয়েছিল। হাতে লেখা ইতিহাসটি ঘেটে দেখা গেল, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু। শেষ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে। দেয়ালপত্রিকার বাকি অংশে গল্প কবিতা। মুদ্রা, ঘুড়ির নাঠাই, খেলার পুতুল, পালকি ইত্যাদি সেঁটে দিয়ে বলা হচ্ছিল ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। যত বড় কাজ তত ছোট সম্পাদক। নামÑ ফাবলিহা। ক্লাস নাইন পড়ুয়া মেয়েটি আবার বিজ্ঞানের ছাত্রী। তাতে কী? ইতিহাস পাঠ ও বর্ণনা মুগ্ধ হওয়ার মতো। ইতিহাস নিয়ে যে লুকোচুরি, বিকৃতি, মেয়েরা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। গ্রিনরোডের ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের চলমান অস্থিরতার চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। তাদের দেয়ালপত্রিকার শিরোনামÑ মানবতার আর্তনাদ। দেশে, দেশের বাইরে যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, সেখানে দৃষ্টি দিয়েছে তারা। দেশে ধর্মের নামে মুক্তচিন্তা খুন, আইএস জঙ্গীদের নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধের অসহায় বলি সমুদ্রতীরে ভেসে ওঠা দেবশিশু আয়লানকে বিষয় করে তারা লিখেছে অমানবিক বিশ্বের আজকের ইতিহাস। দেয়ালিকার লেখক সম্পাদকরা সবাই মেয়ে। লামিশা, তিষা, সুবেহ তারেক, আদিবারা তাই হয়ত পহেলা বৈশাখের উৎসবে টিএসসিতে নারী নির্যাতনের বর্বর ঘটনাটি ভুলতে পারেনি। সেই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে তারা। শিরোনামÑ এক অন্ধকার বৈশাখের গল্প! সেন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালপত্রিকায়ও বিষয় হিসেবে পাওয়া যায় ‘আর্তনাদ’। রং তুলিতে তারাও শোক করেছে আয়লানের জন্য। কাগজের ফুল দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে নিয়ে এর ভেতরে সাহিত্যকর্ম করেছে লালমাটিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উৎসবের বিশেষ দিক বলতে হবে, ঢাকার বাইরের অংশগ্রহণ। বিভিন্ন জেলা থেকে কত কিছু যে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল দেয়ালপত্রিকাগুলো! নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, নদীর কথা, প্রাচীন বৃক্ষ বা স্থাপনার কথা সেখানে লেখা হয়েছে। উপস্থাপনার বৈচিত্র্যের কথা তো বলাই বাহুল্য। সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছে রাজধানীর শহরের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। সিরাজগঞ্জের সবুজ কানন হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেয়ালপত্রিকা সাজিয়েছে কুলা দিয়ে। বেশকিছু কুলা পাশাপাশি সেঁটে দিয়ে সেগুলোতে কবিতা, জীবনী, আবিষ্কার কাহিনী, এমনকি যুদ্ধাপরাধের মতো বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। জয়পুরহাট বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালপত্রিকাটিতে চোখ একবার গেলে আর সরাতে মন চায় না। ‘সরল রেখা’ নামের দেয়ালপত্রিকাটিকে অত্যন্ত আকর্ষনীয় করে গড়া হয়েছে। হুগলাপাতার নরম চাঁটাইকে করা হয়েছে ক্যানভাস। এর চারপাশে রঙিন সুতোয় করা নকশা। মাস্টহেডের নিচে নয়টি কাঁথার টুকরো। তার ওপরে হলুদ কাগজ। প্রতিটিতে একটি করে লেখা। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, জেলা পরিচিতি, প্রধান শিক্ষকের বাণীÑ কী নেই! সম্পদকীয়টাও মজার বটে। পুরো দেয়ালপত্রিকার ভাবনা পরিষ্কার করার পাশাপাশি সম্পাদক সপ্তমী সাহা লাল কালিতে সতর্কবাণী করেছেনÑ দেয়ালপত্রিকার সমস্ত লেখা জয়পুরহাট বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ও সংরক্ষিত! এমন উচ্চারণ থেকে দেয়ালপত্রিকার লেখার মৌলিকত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় বৈকি! চট্টগ্রামের ফরেস্ট্রি সায়েন্স এ্যান্ড টেকনলজি ইনস্টিটিউট দেয়ালপত্রিকা গড়েছিল কাকতাড়ুয়ার আদলে। নওগাঁর জনকল্যাণ মডেল হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেয়ালকিায় তুলো গুজে দিয়ে শরতের আকাশ দৃশ্যমান করেছে। সে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে ঘুড়ি। মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধকে একমাত্র বিষয় করে দেয়ালপত্রিকা করেছে ঝিনাইদহের শিশুকুঞ্জ স্কুল এ্যান্ড কলেজ। ‘রক্তশপথ’ শিরোনামের পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি একাত্তর সালের গণহত্যার স্কেচ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। এভাবে নানা বিষয় ও বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছিল দেয়ালপত্রিকা। আজকের এই যান্ত্রিক সময়ে, অস্থির আত্মকেন্দ্রিক সময়ে কিশোর মনের সৃজনশীল প্রকাশ দেখে সত্যি আশাবাদী হতে হয়। এই ধরনের চর্চা অব্যাহত থাকুকÑ আমাদের তাই প্রত্যাশা।
×