ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

আমার চোখে নারী!

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৯ অক্টোবর ২০১৫

আমার চোখে নারী!

গত সপ্তাহে আমার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক নারী-পুরুষ আমার কাছে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। লেখাটি অনেক মানুষের চোখে পানি এনেছে। যারা তাদের কান্না রোধ করতে পারেননি তাদের জন্য বলছি, ছোট সেই কিশোরীর করুণ অবস্থা আমার চোখেও পানি এনেছিল। সেই মেয়েটির দু’চোখ দিয়ে যে নোনাজল তার কোলের ওপর রাখা হাতে এসে পড়ছিল তার খানিকটা আমাদের চোখ পর্যন্ত গড়ানো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু চেয়েছি, আমাদের দেশের মেয়েরা যেন এমন কষ্টকর পরিস্থিতিতে না পড়ে। পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থায় শুধু আমার পেশীশক্তি আছে বলেই অন্যের ক্ষমতাকে খর্ব করব, সেটা খুবই প্রিমিটিভ যুগের চিন্তাভাবনা। তারপর এই গ্রহ কয়েক মিলিয়নবার তার কক্ষপথে ঘুরে গেছে। আমাদের চিন্তাভাবনা কেন তাহলে ঘুরবে না? যারা আমার সঙ্গে আপনাদের মমতা প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অসংখ্য মানুষ হরেক রকমের প্রশ্ন করেছেন, যার সব উত্তর দিতে গেলে এই কাগজের পরিসর কুলাবে না। তারা জানতে চেয়েছেন আমি যা লিখি তা মন থেকে বিশ্বাস করে লিখি কি না, নারীদের স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি কি-না, নারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া ঠিক আছে কি-না, নারীদের নেতৃত্ব আমি বিশ্বাস করি কি-না, নারীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়। তবে মূল কথা যেটা বুঝতে পারছি তাহলো, আমি নারীদের কিভাবে দেখি তা হয়ত জানতে চেয়েছেন। তাদের জন্য আমার আজকের এই লেখা। দুই. আমি বেড়ে উঠেছি বাংলাদেশের খুবই সাদামাঠা একটি পরিবারে, যেখানে ছেলেদের আধিপত্যটাই বেশি। অন্য ছেলেরা যেভাবে বাংলাদেশে বড় হয়। আমিও তাই। স্কুলে পড়ার শেষ সময়ে এসেই ছেলেমেয়েতে পার্থক্য চোখে পড়ে। প্রাইমারী স্কুলে এবং হাইস্কুলের প্রথম দিকে মেয়েদের সঙ্গে তেমন পার্থক্য অনুধাবন করিনি। আমার অনেক ক্লাসে মেয়েরা ফার্স্ট হতো, তাতে খুব একটা খারাপ লেগেছে কিংবা অন্যভাবে ভেবেছি তা মনে পড়ছে না। তবে ক্লাস এইটের পর থেকে জিনিসগুলো আলাদা হতে শুরু করে। তার একটি কারণ হতে পারে যে, ওটা বয়ঃসন্ধির সময়। আমার যেমন হরমোন পরিবর্তন হচ্ছে, মেয়েদেরও তাই। মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে, প্রতিযোগিতাও। গার্লস স্কুলের ফার্স্ট গার্ল বিতর্কে ভাল করছে, আমাদের বয়েজ স্কুলেরও করতে হবে- এটা যেমন ছিল, পাশাপাশি কারও কারও পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে হার্ট-বিট মিস হতো, সেটাও শুরু হয়ে গেল। আমি মনে করি আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় আমার হাইস্কুল জীবন। আমি আমার হাইস্কুল জীবনে যতটা মানসিক কষ্ট করেছি, সারা জীবনে তা করিনি। কারণ, আমার কোন গাইড ছিল না। মেয়েদের প্রতি আমার আচরণ কী হওয়া উচিত সেটা বলে দেয়ার মতো কেউ ছিল না। মা ছিলেন মহা কড়া। তার মূল কনসার্ন ছিল, কারও প্রেমে পড়ে কিংবা কারও পেছনে ঘুরে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ি কি-না। তাই তিনি কঠিন চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু আমার নিজেকে অনেক বেশি কনফিউজড মনে হতো। কার সঙ্গে সম্পর্কের গতিবিধি কী হবে সেটা বুঝে উঠতে পারতাম না। এক মেয়ের চোখ পছন্দ হয় তো আরেক মেয়ের নখ। কারও হাসি, আর কারও চুল। আজ কারও জন্য ঘুম হারাম হয়েছে তো কিছুদিন পর আরেকজনের জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছি। তারপর আছে বড় আপাদের যন্ত্রণা। তাদেরকেও ভাল লাগে। কিন্তু কেউ বলে দেয়ার ছিল না কোন্ ভাললাগার অর্থ কী। কিংবা কার সঙ্গে ঠিক কী ব্যবহার করতে হবে, আর কোন্্টা করা যাবে না। মার আদেশ মেয়েদের সঙ্গে মেশা যাবে না। সেটা মেনে নিয়ে লেখাপড়ায় মন দেই। কিন্তু ভেতরে তো বিশাল ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ত, যা বন্ধুরাও জানত না। এটাও হলো যে, স্কুলের খুব ব্রিলিয়ান্ট কিছু ছেলে কিভাবে যেন লেখাপড়া থেকে দূরে সরে গেলো। তাদের পাওয়া যেত গার্লস স্কুলের সামনে, নয়ত অঙ্ক স্যারের বাসার গলিতে। আমার এখনও ভাবলে শরীর হিম হয়ে আসে, সেই পরিবেশ এবং বখে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে কিভাবে আমি বের হয়ে এলাম! আমি সত্যিই জানি না। তবে সকল প্রশ্নের উত্তরটি হয়ত আমার মা। আমার মার আঁচল আমাকে বিভিন্ন বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অবশ্য আর ততটা ঝামেলা হয়নি। তখন মাথায় লেখাপড়া ঢুকে গেছে। ক্যারিয়ার বুঝতে শিখেছি এবং মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়তে হবে সেটাও চলে গেছে। রুচি পরিবর্তন হয়ে গেছে। চিন্তাভাবনা পাল্টে গেছে। কিন্তু একটা ছেলে তার স্কুল জীবনে কতটা কনফিউজ থাকে তা আমার চেয়ে ভাল আর কে বলতে পারে! তাই আমি মনে করি, প্রতিটি মা-বাবার উচিত তার স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা। তাদের হাজার রকমের প্রশ্ন থাকে মনে, সেগুলোকে এ্যাড্রেস করা। এগুলোকে এড়িয়ে গেলে তারা এক ধরনের কনফিউশন নিয়ে বেড়ে ওঠে। ওই বয়সে যে কোন একটি মেয়েকে দেখলেই তার পেতে ইচ্ছে করে। আর সেটা না পারলে তার মুখে এসিড মারো, নয়ত বন্ধুরা মিলে তুলে নিয়ে এসে ধর্ষণ কর। আর সেটুকুও না পারলে অন্ধকারে একা পেলে গায়ে হাত দিয়ে দেব। এগুলো ছেলেদের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। তারা যদি ছোটবেলা থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিকভাবে ব্রিফিং পায়, তখন বিষয়গুলো ততটা প্রকট হয় না। সে জানে বোনদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, বোনের বন্ধুদের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্ক রাখতে হয়, ক্লাসের মেয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয়। এটা নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। তাদের মনোজগতে যে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় সেগুলোকে এ্যাড্রেস করাটা জরুরী। নয়ত আপনার ছেলে যদি পরবর্তী সময়ে মেয়েদের সেক্স করার বস্তু ছাড়া আর কিছু না ভাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তিন. বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এবং পাস করে অনেক দিন চাকরি করেও মেয়েদের সম্পর্কে আমার ধারণা সঠিক ছিল বলে আমি মনে করি না। আমার দৃষ্টিভঙ্গি খুবই খারাপ ছিল। মেয়েদের তাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা ভেতরে ছিল বৈকি! পরিবারের নিজের বোনদের কাছ থেকে বাড়তি আদর নেয়া (এবং আদরের নামে তাদের দিয়ে নিজের কাজগুলো করিয়ে নেয়া) সঠিক কাজ ছিল বলে আমি এখন আর মনে করি না। আমার ছোট ভাই তো আমার শার্টটা ধুয়ে ইস্ত্রি করে দেয়নি, তাহলে ছোট বোনটা কেন করে দেবে! সেটা তখন মাথায় আসেনি। মনে হয়েছে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলে ওরাই তো এগুলো করে দেবে। কিন্তু একবারের জন্যও প্রশ্ন আসেনি, কেন ওরা করবে? ওদেরও তো লেখাপড়া আছে, ওরাও তো আমার একই মা-বাবার সন্তান, আমাদের পরিবারে আমার যা অধিকার, তাদেরও তাই। তবে ওরা কেন নিজের লেখাপড়া ফেলে রেখে আমার জামাকাপড় ধোবে? তবে একটি বিষয় কিভাবে যেন মাথায় ঢুকে গিয়েছিল- আমি কখনই মনে করতাম না, আমার বোনেরা সম্পত্তির ভাগ কম পাবে। ইসলামের নিয়মে বোনেরা সম্পত্তির হিস্যা কম পায়। এটা জানার পরও একবারের জন্যও মাথায় আসেনি যে, আমার ছোট বোনটা আমার থেকে কম সম্পত্তি পাবে। বরং সব সময় মনে হয়েছে আমারটা ওরা নিয়ে যাক। আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না! শুধু এটুকু বৈষম্যহীনতা ছাড়া আমি চরম বৈষম্যপূর্ণ ধ্যান-জ্ঞান নিয়ে বড় হয়েছি। মেয়েরা বাইরে যাবে কেন, মেয়েদের আবার ছেলেবন্ধু কিসের, মেয়েরা রেজাল্ট ভাল করবে কেন, আর ভাল করলেই কি, ওরা তো বিয়ে করে রান্নাঘরে চলে যাবে, আমাদের রান্না করে খাওয়াবে, আমাদের কাপড় ঠিক করে দেবে, আমাদের সন্তানদের বড় করবে, আমরা উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে, মাঝে মাঝে শখ করে কিছু কিনে দেব, তাদের নিজেদের কোন শখ থাকতে পারবে না- এমন অসংখ্য বাজে ধারণা নিয়ে অনেকটা জীবন পার করে ফেলেছি। এখন তা নিয়ে লজ্জা হয়। মাথা নিচু করে থাকি। বুয়েটের সবচেয়ে ভাল সাবজেক্টে পড়ার পরেও আমি ভাবতাম, মেয়েরা আবার পাস করে চাকরি করবে নাকি! চাকরি করব আমরা ছেলেরা। অফিস থেকে বাসায় ফিরব। স্ত্রী রান্না করবে, সুন্দর করে ঘর গুছিয়ে রাখবে, হাতে পাখা নিয়ে বাতাস করবে, পানি এগিয়ে দেবে, আমি আরাম করে খেয়ে তাকে ধন্য করব। রান্নাঘরে গরমে তার কষ্ট হয়েছে কি-না তা তো আমার জানার দরকার নেই; আমার অফিসে তো এসি আছে। তারপর বাসায় এসে ফ্যান না চললেও স্ত্রীর হাত তো থেমে নেই। এমনকি ঘুমাতে যাবার আগে মশারিটা পর্যন্ত লাগানোর মতো শক্তি থাকে না আমাদের। সারাটা দিন পুরো সংসার সামলিয়ে তারপর শুধু মশারি টানানো নয়, মশারির ভেতর গরমে স্ত্রীর হাতে হাতপাখার বাতাস না খেলে তৃপ্তি হবে না। কাজের মেয়ের সঙ্গে তো আর ঘুমাতে পারি না (অনেকে অবশ্য সেটাও পারে), তাই একটা বউ প্রয়োজন। বউ লেখাপড়া জানলে ভাল, গান গাইতে পারলে আরও ভাল। বউয়ের ঢাকায় বাড়ি থাকলে তার যোগ্যতা আরও বেশি। বুয়েট থেকে পাস করে অনেককেই দেখলাম বিয়ে করার সময় জিজ্ঞেস করছে, মেয়ের ঢাকায় বাড়ি আছে কয়টা। একজন নারীকে উঁচুদরের কাজের বুয়া এবং সেক্স-ওয়ার্কার ছাড়া আর বেশি কিছু ভেবেছি বলে মনে হয় না। মেয়েরা আমার মতো স্বামী পাবার যোগ্যতা অর্জনের জন্য লেখাপড়া করবে, কেউ কেউ কাজও করবে। বিয়ে নামক একটি অদ্ভুত সার্টিফিকেটের অন্তরালে এটাই তো ভেবেছি। এমন সব অসভ্য, বর্বর, সাইকোপ্যাথ, অসুস্থ চিন্তা-চেতনা নিয়ে জীবন পার করে দিয়েছি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছেলেই আমার মতো চিন্তা-চেতনা নিয়ে বড় হয়, জীবন পার করে তাতে সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি যে খুব একটা বদলেছে তাও মনে হয় না। চার. আমি মূলত পাল্টাতে শুরু করেছি, আমার মেয়ে যখন এই গ্রহে এলো। ব্যাপারটি এমন নয় যে, আমি আমার মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি যে ব্যবহার করতে শুরু করি তা রীতিমতো আমাকে পাল্টে দেয়। আমরা খেয়াল করে দেখলাম, ওই ছোট মেয়েটিকে যখন আমরা সম্মান করছি, তাকে সম্মান করে ব্যবহার করছি আমাদের মেয়েটিও সেটা ফেরত দিচ্ছে। আমরা ওকে যতটা সম্মান দিচ্ছি, সেও আমাদের সেটা ফেরত দিচ্ছে। অদ্ভুত শিক্ষা। এত সরাসরি ফলাফল আগে কোথাও পাইনি। আমার মেয়ে যত বড় হতে শুরু করে আমারও চিন্তায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমার পুরুষ হওয়ার বয়স বাবা হওয়ার বয়সের সমান। আমার মেয়ের জন্ম না হলে আমি যেমন বাবা হতে পারতাম না, তেমনি নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাত না। এতটা বয়সে এসে আমি এখন নির্ভয়ে বলতে পারি, আমি একজন নারীকে সম্মান করতে শিখেছি, তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে ভাবতে পারছি। আমি বিশ্বাস করি, পুরুষরা যেমন একটি বিশেষ প্রজাতির প্রাণী, নারীরাও তাই। তাদের ভেতর অনেক ধরনের মিল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অমিল। কোন্টা ভাল আর কোন্টা মন্দ সেটা এখানে বিচার করা যাবে না। কারণ, দুটোর মাপকাঠি ভিন্ন। অনেককেই দেখি, পুরুষ আর নারীর ভেতর তুলনা করে। আমিও এক সময় করতাম। এখন আর করি না। একজন পুরুষের সঙ্গে নারীর তুলনা হতে পারে না। একজন পুরুষের সঙ্গে আরেকজন পুরুষের তুলনা হতে পারে; একইভাবে একজন নারীর সঙ্গে আরেকজন নারীর তুলনা হতে পারে। এই গ্রহে তাদের গতি-প্রকৃতি ভিন্ন। আমি বিশ্বাস করি, কিছু কিছু কাজ ছেলেরা ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে; একইভাবে কিছু কিছু কাজ মেয়েরা ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারে। যেমন, আমি মনে করি না, নারীদের যুদ্ধে (কিংবা সেনাবাহিনীতে) পাঠানো ঠিক কাজ। পৃথিবীর কিছু উন্নত দেশ এটা শুরু করেছে। হয়ত তারাই সঠিক। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে। আবার একটি স্কুলে আমি মেয়ে শিক্ষকের বিকল্প চিন্তাই করতে পারি না। আমার বাচ্চাটিকে একজন নারী শিক্ষক যেভাবে পড়াবেন একজন পুরুষ শিক্ষক সেটা পারবেন বলে মনে হয় না। এমন অসংখ্য কাজের ক্ষেত্র বলা যাবে, সেখানে কিছু জায়গায় নারীরা ভাল, আবার কিছু জায়গায় পুরুষ। দু’জন মিলে এই পৃথিবী। আমি বিশ্বাস করি, ছেলে এবং মেয়েতে ভাল বন্ধুত্ব হতে পারে। আমার চমৎকার কিছু মেয়ে বন্ধু আছে, তারা আমার জীবনের পরম সম্পদ। একেক বন্ধুর সঙ্গে একেক রকমের সম্পর্ক যেমনটা হয় ছেলেদের সঙ্গেও। আমি খেয়াল করেছি, একটি সম্মানজনক বন্ধুত্ব যদি রাখা যায় তাহলে মেয়েদের চেয়ে ভাল বন্ধু অনেক ছেলেও হয় না। ছেলেদের মাঝে এক ধরনের প্রফেশনাল ঈর্ষা থাকে, যা মেয়েদের ভেতর থাকে না। (তবে একজন মেয়ের জন্য আরেকজন মেয়ের ঈর্ষা থাকতে পারে। খুবই জটিল সম্পর্ক!) মেয়েরা ছেলেদের খুব ভাল বন্ধু হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, মেয়েরাও ভাল নেতৃত্ব দিতে পারে। মেয়েরাও স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে, সে তার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে তার শখ পূরণ করতে পারে, সে তার মতো চলাফেরা করতে পারে, সে তার মতামত ব্যক্ত করতে পারে। তবে এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার থাকাটা জরুরী। কেউ শুধু মেয়ে বলে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে কিংবা একটি এক্সকিউজ পাবে- তাতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি যেমন একটি ছেলেকে তার পারফরমেন্সের জন্য ধিক্কার দেই, একই ধিক্কার একটি মেয়েও ডিজার্ভ করে। আমি তাকে করুণা করে ছোট করতে চাই না। একটি মেয়ের যুক্তিতে ভুল থাকলে তাকে যেমন ধমক দেব, একই ধমকটি খাবে একটি যুক্তিহীন ছেলে। তবে অনেক মেয়েই এটি বুঝতে পারে না। তারা যেহেতু সারাক্ষণ এক ধরনের আন্ডারমাইন্ড অবস্থার ভেতর দিয়ে জীবন পার করেন, তাদের সম্মান দেখালে কখনও উল্টোটাও ঘটতে পারে। সে তখন আপনার সঙ্গে একদম চাকরের মতো ব্যবহার করতে শুরু করবে। তারা সম্মানের মর্মটা হয়ত এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। একজন আত্মসম্মানসম্পন্ন মানুষই কেবল আরেকজন মানুষকে যথার্থ সম্মান দেখাতে পারে- সেটা ছেলে হোক আর মেয়েই হোক। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। পাঁচ. লেখাটা বড় হয়ে গেল। তবুও ছোট একটা ঘটনা এখানে না লিখে পারছি না। কয়েক মাস আগে খুবই সুন্দরী একজন মেয়ে আমাকে মেসেজ পাঠাল। ছবিতে তাকে এত সুন্দর লাগছে যে, চোখ সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। আমি ধীরে ধীরে তার লম্বা মেসেজ পড়তে থাকি। কয়েক দিন আগে তিনি তার স্বামীর সংসার ছেড়ে নতুন শহরে এসে উঠেছেন। উন্নত দেশে থাকার পরেও কোন রকমে জীবন বাঁচিয়ে ঘর ছেড়েছেন। তার স্বামী তাকে ব্লেড দিয়ে, জ্যামিতি বাক্সের কাঁটা-কম্পাস দিয়ে, ছুরি দিয়ে শরীরে আঘাত করত। শীতের এক রাতে ছোট বাচ্চাটিকে রেখে দিয়ে তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে সেই পুরুষ। পুলিশের সাহায্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্ধুর বাসায়। তারপর ভিন্ন শহরে এসে থাকতে শুরু করা। মেয়েটির করুণ এই ঘটনা পড়তে পড়তে চোখ ভারি হয়ে আসছিল। কিন্তু সবশেষের লাইনটি এসে আমার গালে বিশাল একটা চড় লাগাল। শেষ লাইনে এসে তিনি যেই পুরুষটির নাম লিখেছেন সে আর কেউ নয়, আমার একজন সহপাঠী, যার সঙ্গে আমি বুয়েটে পাঁচটি বছর লেখাপড়া করেছি এবং যাকে আমরা এই দেশের একজন সেরা ছাত্র হিসেবে ভাবতাম। তার বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম। আমাদের ক্লাসের সবাই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সে-ও তাই। কিন্তু মেয়েটি যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সেটা আমার জানা ছিল না। আমি নিশ্চিত, আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলে সে তার পক্ষে অনেক কিছুই বলবে। আমি কারও ব্যক্তিগত জীবনের ভেতর প্রবেশ করি না। তাই বন্ধুটিকে কিছু বলা হয়নি। তবে একজন মানুষকে এভাবে অত্যাচার করতে হবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আমি মনে-প্রাণে চাই, মেয়েটি নিজের মতো করে তার জীবনকে সাজিয়ে নিক! একজন অসুস্থ কাপুরুষের সঙ্গে থাকার চেয়ে একা থাকার মতো শান্তি এই পৃথিবীতে নেই, যদিও অনেক মেয়েই এটা বুঝতে পারে না, কিংবা তাদের কখনই আমরা সেটা বুঝতে দেইনি- আমাদের জন্য, পুরুষদের জন্য! নিজের পায়ে দাঁড়াও, দেখবে পৃথিবী হলো বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরতম গ্রহ। ১৭ অক্টোবর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম [email protected]
×