ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুব্রতা রায় ত্রিবেদী

শৈশব স্মৃতিতে দুর্গাপূজা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২০ অক্টোবর ২০১৫

শৈশব স্মৃতিতে দুর্গাপূজা

আজকাল পূজার কথা মনে হলেই ছেলেবেলাকার কথা খুবই মনে পড়ে। তখন এখানকার মতো হয়ত পূজায় এত জাঁকজমক ঐশ্বর্য ছিল না তবে একটা নির্ভেজাল আনন্দ ছিল, যা ছিল একেবারে ষোলোআনা খাঁটি। মনে পড়ে শৈশবের কুমিল্লার পূজার কথা। মফস্বলের একটি জেলা শহরের পূজার কথা। তখন পূজায় প্রকৃতির মাঝে একটা সাজ সাজ রব। কারণ প্রকৃতি তো মানুষের বন্ধুর মতোই। এখনকার মতো এত বৈরী ছিল না বললেই চলে। তখন ষড়ঋতুর পালাবদলে ঋতুচক্রকে বড়ই ঐশ্বর্যময়ী, অপূর্ব আর প্রাণবন্ত মনে হতো। একেকটা ঋতু স্বমহিমায় আবির্ভূত হতো। শরতকালে আগমনীর আমেজে এর আকাশ-বাতাস ভরপুর। আকাশে ভেড়ার পালের মতো শ্বেত-শুভ্র মেঘমালা শিউলির মন মাতানো স্নিগ্ধতায় আর অন্যান্য ফুলের সুবাসে চারদিক মউ মউ করত। সকালবেলা শিউলি কুড়াতে দলবেঁধে কত বাড়িতে যেতাম। ফুলে ফুলে প্রজাপতির মেলা আর সবার খুশি মিলে যেন অন্য এক রকম আনন্দ ছিল। প্রায় সব বাড়িতেই ফুলের কেয়ারি করা বাগান ছিল। চারদিকে সবুজ, সবুজ আর সবুজ। যেন এক সবুজ পৃথিবীর গল্প। বাড়ির সামনে পথের ধারে পুকুরের পাশে যেমনি ছিল চাঁপা, করবী, কড়ই আর পলাশ ফুলের গাছ, তেমনি ছিল আগাছা-নানান বুনোফুলের ঝাড়। রাস্তায় কত নাম না জানা ফুলের সমারোহ। কত পূজা হতো রানীর বাজার, বাগিচাগাঁও, কান্দিরপাড়, রাজেশ্বরী কালীবাড়ি, কাত্যায়নী কালীবাড়ি; আবার কাত্যায়নী কালীবাড়ির গা ঘেঁষেই একটা বিরাট পূজা। পূজার সংঘের নাম স্বপনপুরী। আরও বেশ কিছুদূর গেলে ঈশ্বর পাঠশালার পূজা। তাছাড়া কান্দিরপাড়, মনোহরপুর, চকবাজার, পানপট্টি কত পূজা সব কি মনে আছে? স্মৃতির পাখায় ভর করে আমি যেন শৈশবের সেই দিনগুলোতে সেই সোনালি অতীতে ফিরে যাই। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে পূজার আনন্দ। মনে পড়ে মহালয়ার পুণ্য তিথিতে সেই কাকভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সুললিত কণ্ঠের মহালয়ার স্তোত্রপাঠ। সত্যিই আবছা সকালের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়ে একটা অদ্ভুত আমেজের সৃষ্টি করত। আর পূজার আগে আকাশবাণীতে কলকাতার আগমনী গান শুনতাম। দেবী দুর্গার আরেক রূপ শিব-পার্বতীর দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের আধারে এগুলো রচিত হতো। পূজার আগে এর আবেদন তাই মধুর। আমি যেন খ- খ- স্মৃতির পসরা সাজিয়ে বসেছি। আমার মাঝে যেন এক ধরনের নস্টালজিয়া কাজ করতে শুরু করেছে। তখন আমাদের পাড়ায় কোন পূজা ছিল না। রাজেশ্বরী কালীবাড়ি বাসা থেকে অনেকটা দূরে। তাই অষ্টমী তিথিতে মা নৈবেদ্য সাজিয়ে রিক্সা করে কালীবাড়িতে যেতেন। আমরা পাশের পাড়ায় রানীর বাজারে নতুন জামা পরে অঞ্জলি দিতাম। কখনওবা মায়ের সঙ্গীও হতাম। আর সন্ধ্যায় আমরা সেজেগুজে পাড়াপ্রতিবেশী মিলে অনেক সময় ঘণ্টা হিসেবে রিক্সা ঠিক করে প্রতিমা দেখতে যেতাম। সপ্তমীর দিন বিশেষ করে অষ্টমীতেই পূজার ভিড় হতো বেশি। আর অন্য সময় পাশের পাড়ায় গিয়ে পূজা দেখে চলে আসতাম কখনও বোনদের সঙ্গে কখনওবা পাড়ার কোন বন্ধুর সঙ্গে। মাইকে নানান গান বাজত। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ইলা বসুÑ কত নাম বলব। পূজার আনন্দ আর গান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। পাড়ার প্রায় সব বাড়িতেই নিমন্ত্রণ থাকত। সন্দেশ, নাড়ু, মুড়কি, লুচি, পায়েস, ফলমূল কতকিছু। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই পূজা উপলক্ষে কত কী ঘরের খাবার তৈরি করত। অত কি খাওয়া যায়? তাছাড়া বাড়ি তো আছেই। তবে দু-একটা বাড়িতে যেতেই হতো। আমার মায়ের অনেক রাত জেগে তৈরি করা সন্দেশ, নাড়ু, তিলের তক্তি, নারকেলের নাড়ু, নারকেল ও ক্ষীরের সন্দেশ, মোদক কতকিছু। মনে পড়ে আমার ছোটবেলার বন্ধু বেবী বলত, ‘মাসিমার সন্দেশের কোন তুলনা নেই।’ আমাদের বাড়ির সামনে বিরাট এক পুকুরে নানান পার্বণে কত প্রদীপ ভাসাত পাড়ার বৌ-ঝিরা। তা জ্বলতে জ্বলতে কী অপরূপই না হয়ে উঠত। পূজার সময়ও অনেকে প্রদীপ ভাসাত, যা হাওয়ার তালে দুলতে দুলতে এক সময় দূরে চলে যেত। কোন কোনটা আবার জ্বলতে না জ্বলতেই নিভে যেত। আর পুকুরে এর প্রতিবিম্ব পড়ে তা আরও সুন্দর, আরও অপূর্ব হয়ে উঠত। আর নবমী শেষে দশমীতে একটা বিদায়ের সুর যেন বেজে উঠত ঢাকের বাদ্যিতে। বিসর্জনের বাজনা চোখে জল এনে দিত। আবার মা দুর্গাকে পুনরায় আসার সুপ্ত বাসনা জানিয়ে সজল চোখে বাড়িতে ফিরে আসতাম। এবারকার পূজায় অনেকেই নেই। রাংগাদি, বৌদি, জামাইবাবু, নানুদা, মহারাজ অনেকেই নেই। তারা পূজার আনন্দটাকে দ্বিগুণ করত। কিন্তু তারা চলে গেছেন জীবনের অপর প্রান্তে সেই অজানালোকে, যেখানে গেলে আর কেউ ফেরে না। আর ওদের স্মৃতি বুকে ধারণ করে আমরা যক্ষের মতো বেঁচে আছি। আর আমরা চিরদিন বেঁচে থাকবÑ এ বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি। তবু যারা আছে তাদের মঙ্গল আর শুভকামনায় পূজার আনন্দে মেতে উঠতে হবে।
×