আজাদ সুলায়মান ॥ মাফিয়ার কবলে পড়েছে রাজধানীর গণপরিবহন। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না পরিবহন মালিক শ্রমিকদের অযৌক্তিক ও হঠকারী আন্দোলন। বাড়তি ভাড়া আদায়সহ তুচ্ছ অজুহাতে যখন-তখন বিনা নোটিসে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কোটি মানুষ চলাচলের গণপরিবহনকে। এজন্য রাজধানীবাসীকে সোমবারও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ সেটা আঁচ করতে পেরে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলতে বাধ্য হয়েছেন- পরিবহন সেক্টর অচল হয়ে গেলেও অভিযান চলবে। বাড়তি ভাড়া আদায়ের নামে জুলুমবাজি বরদাশত করা হবে না। কিছুতেই এ ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে না।
রাজধানীতে পর পর দুই দিন গণপরিবহনের তীব্র সঙ্কট থাকলেও মালিক ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তারা দ্বিতীয় দিনের পরিবহন সঙ্কটের কথা স্বীকার করতেই রাজি নন। হঠাৎ বিনা নোটিসে বিনা ঘোষণায় সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাস বন্ধ করে দেয়ায় লাখ লাখ যাত্রীর কপালে নেমে আসে সীমাহীন ভোগান্তি। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন প্রতিনিধিকেই পরিবহন সেক্টরের এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিরসনের উদ্যোগ নিতেও দেখা যায়নি। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের এহেন অবস্থা দেখে ভুক্তভোগী যাত্রীদের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। একজন মহিলা যাত্রীকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বাসের মালিকদের অভিশাপ দিতেও শোনা যায়।
আর পরিবহন মালিকদের সংগঠন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গণদুর্ভোগের বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। রবিবার শ্রমিকরা গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছিলÑ সেটা আমি ঠিক করে দিয়েছি। এখন তো সমস্যা নেই। রাতের মধ্যে পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ নিয়ে তো তেমন সঙ্কট দেখছি না।
তার এ কথার বিপরীত চিত্র ছিল গোটা রাজধানীতে। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায় সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য।
উল্লেখ্য, রবিবার বাড়তি ভাডা আদায় ও ভাডার তালিকা না থাকায় আগারগাঁও এলাকার আবহাওয়ায় অধিদফতরের সামনে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী হিমাচল পরিবহনের চালকের সহকারীকে এক মাসের কারাদ- দেয়। এর জের ধরে ওই এলাকার বাস শ্রমিকরা প্রতিবাদ শুরু করেন। তারা মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমের প্রতিবাদে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বাস বন্ধ করে দেন। একই সঙ্গে বাস বন্ধ করে শ্রমিকদের প্রতিবাদের নামে গোটা রাজধানীতে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের মতো অবস্থার সৃষ্টি করে। এতে পর পর দুই দিন ধরে গোটা রাজধানীতে গণপরিবহনের তীব্র সঙ্কট নেমে আসে। সকাল বেলা অফিস সময়ে প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে শত শত যাত্রীকে তীর্থের কাকের মতো গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। জনকণ্ঠের এই প্রতিনিধি নিজেও দুই দিন এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তিনি এয়ারপোর্ট থেকে সোমবার সকালে প্রেসক্লাবে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোন সিটি সার্ভিসের বাস মিনিবাস পাননি। একপর্যায়ে ময়মনসিংহ থেকে দূরপাল্লার বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে করে মহাখালী টার্মিনালে আসেন। কিন্তু মহাখালী থেকে প্রেসক্লাবে কোন গাড়ির দেখা পাননি। আরও এক ঘণ্টা থাকার পর হঠাৎ একটা বলাকা পরিবহন আসে। সেটা থামার পরই অপেক্ষমাণ ৩০-৩৫ জন যাত্রী তা ঘিরে ফেলেন। সবাই একসঙ্গে হুড়োহুড়ি কওে উঠতে গিয়ে দুইজন পড়ে যান। এক দম্পতির বিপত্তি ছিল আরও ভয়ানক। স্ত্রীকে তিনি উঠিয়ে দেয়ার পর নিজে উঠতে পারেননি। পরে তাকে ফেলে রেখেই বাস রওনা দেয়। এতে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। অনেকটা দূরে যাওয়ার পর গাড়ি থামিয়ে স্ত্রীকে নামানো হয়। তাকে নামানোর সময় অন্য যাত্রীরা ওই গাড়িতে উঠতে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।
এমন চিত্র শুধু মহাখালীর নয়। ফার্মগেট, মতিঝিল, পল্লবী, ১০ নম্বর গোল চক্কর, গাবতলী, বিশ্বরোড, গুলিস্তান ও সায়েদাবাদ পর্যন্ত হাজার হাজার যাত্রী বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা সবাই চরম দুর্ভোগের শিকার হন। অনেকে বাস না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ কেউ বাড়তি ভাডা দিয়ে অটোরিক্সায় গন্তব্যে পৌঁছান। দুপুরের দিকে প্রেসক্লাব, বাংলামোটর, কাওরানবাজার, ফার্মগেট ও মহাখালী এলাকায় মানুষকে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তখনও অনেকেই জানতেন না বাস না থাকার কারণ।
এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া যাত্রীরা কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রীর। হাসান নামের এক যাত্রীকে বলতে শোনা যায়, বাস মালিকদের কাছে গোটা দেশ জিম্মি। ওরা মাফিয়া চক্রের চেয়েও শক্তিশালী। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা হলেও খুনের মামলা করা যাবে না। বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও শাস্তিু দেয়া যাবে না। ওরা যখন-তখন কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বাস-মিনিবাস বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। যেন এ সেক্টর দেখার কেউ নেই। যোগাযোগ মন্ত্রীর কথায় কেউ কর্ণপাত করছে না। এমন অরাজকতা আর কতকাল চলবে? তিনি তো ব্যবস্থা নিতে পারেন- যারা গাড়ি বন্ধ রেখেছেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে।
সোমবার দুপুরে পাঁচ বছরের শিশুকন্যা মুক্তিকে নিয়ে দুইবার চেষ্টা করেও বনানী থেকে মিরপুরের গাড়িতে উঠতে পারেননি হালিমা। তার ক্ষোভ- এখন তো হরতাল নেই। কোন অবরোধও নেই। তবুও কেন গাড়ি বের হবে না। এরা কি তাহলে তুচ্ছ ঘটনায় মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়?
ঠিক এ সময় মহাখালী এলাকায় গাজীপুর-সায়েদাবাদ রুটে চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের একটি বাস চালকের সঙ্গে কথা হয়।