ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২১ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোরের আরও স্মৃতি (১৯ অক্টোবরের পর) আমার কৈশোরে ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য বিবর্তন নিয়ে যে মহাকা- শুরু হলো তাতে অল্প বয়সেই শুধু রাজনীতি সচেতন হলাম না, বরং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলাম। ১৯৪৫ সাল থেকেই রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার খ্যাতনামা জেনারেল লর্ড ওয়াভেলকে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে। আগেই বলেছি, ঐ বছরই সুভাষ বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি জাপানের পক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠে। অবশ্য পরের বছরই মিত্রশক্তির যুদ্ধ বিজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালে জুন মাসের ১৫ তারিখে লর্ড ওয়াভেল ভারতবর্ষের ভবিষ্যত সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে সিমলা কনফারেন্স আহ্বান করেন। এই আলোচনা ১৬ জুলাই পর্যন্ত বহাল থাকে। লর্ড ওয়াভেল চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রস্তুতি হিসেবে এখনই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা প্রয়োজন। ১৯৩৭ সালে যদিও আইন পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হন, কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠনে ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছাটাই ছিল মুখ্য। তিনি ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতীয় কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন করলেন। স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশ সরকার তিন সদস্যের একটি কেবিনেট মিশন প্রেরণ করে ১৯৪৬ সালের ২৩ মার্চে। তারা ১৬ মে প্রস্তাব দেন যে, ভারতে একটি কনফেডারেশন হবে, যার অধীনে তিনটি এলাকা থাকবে। একটি বিভাগে থাকবে আসাম এবং বাংলা প্রদেশ, আর একটি বিভাগে থাকবে পাঞ্জাব থেকে সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চিমের এলাকা। আর তৃতীয় বিভাগটি হবে বাকি প্রদেশগুলোকে নিয়ে। এই তিনটি বিভাগেই ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন থাকবে। এই পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের দাবি রাখল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কংগ্রেস সভাপতি প-িত জওহরলাল নেহরুর একগুঁয়েমির কারণে পাকিস্তান দাবিটি আগস্ট মাসে শক্তি লাভ করল। এখানে বলে রাখা ভাল, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেহরুর কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, ভারতের সব প্রদেশে যে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক না কেন প্রাদেশিক সরকারগুলোকে সর্বদলীয় কোয়ালিশন সরকার হিসেবে গঠন করা যথার্থ হবে। এই প্রস্তাবটিও প-িত জওহরলাল নেহরু তখন নাকচ করে দেন। কংগ্রেসের নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ এই সম্বন্ধে একটি মন্তব্য করেন, যেটি তার মৃত্যুর বিশ বছর পর প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে বলেন, ১৯৩৭ সালে প-িত জওহরলাল নেহরু মুসলিম লীগের প্রস্তাব গ্রহণ না করে একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন এবং সেই ভুলটি আরও ব্যাপকভাবে তিনি ১৯৪৬ সালে করেন। মওলানা আজাদের ধারণা ছিল যে, মুসলিম লীগের এই দুটি দাবি গৃহীত হলে ভারত বিভাগের সম্ভাবনা মোটামুটি রহিত হয়ে যেত। যাই হোক, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে দলীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। দলীয় মন্ত্রিসভার অধীনে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ কর্মদিবস (ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে) পালন করে। এই দিনে কলকাতায়, বিহারে এবং অন্যান্য জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূচনা হয়। এই দাঙ্গায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত হন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস তাকে সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। মহাত্মা গান্ধীকে কলকাতায় শান্তি মিশনে নামানো হয়। সোহরাওয়ার্দী গান্ধীর সঙ্গে এই শান্তি মিশনে নিজেকে নিবেদিত করলেন। সেই সময় নোয়াখালীতে আবার দাঙ্গা বাধে এবং সেখানে শান্তি মিশনে ছুটলেন মহাত্মা গান্ধী ও তার সহচর হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নোয়াখালীতে তাদের শান্তি মিশন সফল হলো। কিন্তু ভারতের অন্যান্য স্থানে বিশেষ করে বিহার ও পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করল। এক কথায় বলা যেতে পারে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই ভারত বিভাগকে অবধারিত করে তোলে। তাও হয়ত পরিহার করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারত; কিন্তু দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত তিক্ততা ও অভিমত ভারত বিভাগকে নিশ্চিত করে দেয়। এদের একজন ছিলেন প-িত জওহরলাল নেহরু এবং অন্যজন ছিলেন অত্যন্ত নির্বোধ এবং অহঙ্কারী ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। লর্ড ওয়াভেলের প্রচেষ্টায় ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী হন প-িত জওহরলাল নেহরু। এর সদস্য ছিলেন বারোজন। তবে এতে মুসলিম লীগ অদূর ভবিষ্যতে যোগ দেবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ২৬ অক্টোবর সেই সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভা চৌদ্দ সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। সেখানে মুসলিম লীগের প্রতিনিধি ছিলেন লিয়াকত আলী খান, সরদার আবদুর রব নিশতার, ইব্রাহিম ঢুন্দ্রীগড়, রাজা গজনফর আলী এবং যোগেন্দ্রনাথ ম-ল। আর কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন প-িত জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভ বাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জগজীবন রাম এবং রাজা শ্রী গোপালাচারী। শিখদের প্রতিনিধি ছিলেন সরদার বলদেব সিং এবং অন্য সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি ছিলেন জন মাথাই। এই সরকার মার্চ মাসে ভারতের বার্ষিক বাজেট পেশ করে। সরকারের পক্ষে লিয়াকত আলী খান যে বাজেটটি দিলেন তা ছিল মোটামুটিভাবে গরিবের পক্ষে এবং ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে। লবণকর এতে রহিত হয়। লিয়াকত আলীর বাজেট কোনমতেই মন্ত্রিসভার বাজেট ছিল না, সেটা ছিল তার একান্তই নিজের বাজেট। এই মন্ত্রিসভায় সমন্বয় এবং সমঝোতা তেমন যথাযথ ছিল না। বলা হয়, প-িত নেহরু তখনই নিশ্চিত হন যে, মুসলিম লীগের সঙ্গে কাজ করা যাবে না এবং এই কারণেই ভারত বিভাগের পক্ষে তার মত পরিবর্তন করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ব্যাপক প্রসার। সহজেই কট্টরবাদী সরদার বল্লভ বাই প্যাটেল প-িত নেহরুর সঙ্গে ভারত বিভাগ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেন। লর্ড এটলি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের উপদেশ মতো ১৯৪৭ সালের ২৪ মার্চ লর্ড ওয়াভেলের জায়গায় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করেন। লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল নিতান্তই অপরিপক্ব। কিন্তু তিনি একদিকে নামকরা জেনারেল এবং অন্যদিকে রাজপরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে নিজের সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। লর্ড এটলি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থির করে দেন যে, ১৯৪৮ সালের জুনের মধ্যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনকে সেই হিসেবে প্রায় পনেরো মাসের সময় দেয়া হয়। চলবে..
×