ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

উদ্বাস্তুর মহাপ্লাবন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২১ অক্টোবর ২০১৫

উদ্বাস্তুর মহাপ্লাবন

আধুনিক ইতিহাসে কদাচিৎই এমন ঘটেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, রক্তপাতের বিভীষিকা নিয়ে এবং আরও অন্য কারণে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ও স্বদেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বন্ধুর পথ হোক, উত্তাল সাগর হোক কোন বাধাই তারা বাধা হিসেবে মানছে না। প্রথমে ছোট ছোট দলে, পরে আরেকটু বড় আকারে এবং অবশেষে স্রোতের মতো এসব মানুষের ঢল আছড়ে পড়েছে আশপাশের দেশগুলোতে এবং ইউরোপের বুকে। যাত্রাপথে তদের বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্দশা, মুখোমুখি হতে হয়েছে ভারবহ বিপদের। প্রাণ হারিয়েছে হাজারে হাজারে। অনেক হৃদয়স্পর্শী ট্র্যাজেডির জন্ম হয়েছে। তথাপি এই মহাপ্লাবন ঠেকানো যায়নি। বলাই বাহুল্য লাখ লাখ মানুষের এই মহাযাত্রার উৎস মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত সিরিয়ার যুদ্ধ। তবে সিরিয়া ছাড়াও কসোভো, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া ও ইরাক থেকেও মানুষ পালাচ্ছে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি লোক ইউরোপে প্রবেশ করেছে। বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ১০ লাখে দাঁড়াতে পারে। অনেক দেশ তাদের আগমনে বাধা দিচ্ছে। এক পথ বন্ধ করছে তো আরেক পথে এগোচ্ছে তরঙ্গের পর তরঙ্গের আকারে। কখনও দিনে ১০ হাজার করে পাড়ি দিচ্ছে। সবাই যে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে তা নয়। অনেকে উন্নত জীবনের সন্ধানেও যাচ্ছে। এমন লক্ষ্যে গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে মানুষের প্রবাহ গত কয়েক দশক ধরে চলছে। এই প্রবাহ থামবে না। বিশ্বায়নের কারণে এখন কোথাকার জীবন কেমন সবাই জানে। কাজেই নিরাপদ ও উন্নততর জীবনই এভাবে তাদের টেনে নিচ্ছে। প্রতি ১২২ জনে ১ উদ্বাস্তু আজ বিশ্বের প্রতি ১২২ জনের একজন হয় শরণার্থী, না হয় স্বদেশে বাস্তুচ্যুত নয়ত বিদেশে আশ্রয়সন্ধানী। এই জনগোষ্ঠীকে যদি একটা দেশ হিসেবে ধরা হয় তাহলে সেটা হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম দেশ। বলাবাহুল্য, এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই হলো শিশু। ২০১৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ৪২ হাজার ৫শ’ লোক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। ইউরোপে আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সর্বাধিকসংখ্যক উদ্বাস্তুর আগমন ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শীর্ষ যে পাঁচটি দেশ থেকে উদ্বাস্তুর আগমন ঘটেছে সেগুলো হলো- সিরিয়া, কসোভো, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া ও ইরাক। যেসব পথ দিয়ে তারা ইউরোপে গেছে সেগুলো হলো- মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুট, পূর্ব আফ্রিকান রুট, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুট, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুট ও পশ্চিম বলকান রুট। তুরস্ক এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা। সেখানে সিরীয় উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১৯ লাখ। লেবাননের ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন সিরীয় উদ্বাস্তু। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৩০ হাজার লোক বেআইনীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছে। ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এ বছর তিন হাজার লোক সাগরে ডুবে মারা গেছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধই বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তুর সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় ঠেলে দিয়েছে। এদের সিংহভাগ পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছে ইউরোপে। প্রথমে এসেছে ২০-৩০ জন করে। পরে স্রোতের মতো। বহিরাগতের এই ঢল নামায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সামাজিক জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রান্স, গ্রীস, ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে বিদেশীদের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা আগে থেকেই বাড়ছিল। এখন ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। হাঙ্গেরি, চেকপ্রজাতন্ত্রসহ ২৮টি ইউরোপীয় দেশের অনেকেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে যে, নতুন শরণার্থীর আগমনের ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে চাকরি-বাকরি, সরকারী সুযোগ-সুবিধা এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় পরিচিতি নিয়ে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগ মুসলমান হওয়ায় নিরাপত্তার ব্যাপারটিও এসব দেশকে ভাবিয়ে তুলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, এ বছরের শেষ নাগাদ উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হবে। এদের কোথায় রাখা হবে সেটাই এক সমস্যা। লেবাননে ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে যারা ওই ক্ষুদ্র দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। ইউরোপে এ পর্যন্ত যে ৬ লাখ ৩০ হাজার উদ্বাস্তু ঠাঁই নিয়েছে তাতে মহাদেশের জনসংখ্যা স্ফীত হয়েছে ১ শতাংশের কম। সিরীয় উদ্বাস্তুরা লেবানন ছাড়াও প্রথমে আশ্রয় নেয় তুরস্কে। তুরস্কের পশ্চিম তীর থেকে গ্রীস মাত্র তিন মাইল দূরে। সিরীয়রা এ বছরের প্রথম থেকে সেই দূরত্ব পাড়ি দিতে শুরু করে। তারপর উত্তর দিকে কোন কোন অঞ্চলে যেখানে সীমান্ত উন্মুক্ত সেখানে অধিকতর সমৃদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। তারা মেসিডোনিয়া ও সার্বিয়া অতিক্রম করে হাঙ্গেরিতে পৌঁছে, তারপর জার্মানিতে। আরব বসন্ত ও গৃহযুদ্ধ থেকে উদ্বাস্তু সঙ্কট ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ায় স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শুরু হলো আরব বসন্ত তথা গণঅভ্যুত্থান। একে একে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে উৎখাত হলো স্বৈরাচারী শাসকরা। ২০১২ সালের মাঝামাঝি গণবিক্ষোভ বহুলাংশে স্তিমিত হয়ে এলেও সিরিয়া ও লিবিয়ায় তা গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। সিরিয়ায় ২০১১ সালে বাশারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলে সরকার হিংসাত্মক দমননীতির আশ্রয় নেয়। ফলে প্রতিবেশী লেবাননে নতুন উদ্বাস্তুর প্রথম ঢল নামে। পরের মাসে উত্তর সিরিয়ায় জিসর আল-শুঘুরে বিদ্রোহীদের অবরোধ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধ তীব্রতর রূপ নেয় এবং মে মাসের মাঝামাঝি তুরস্কে গিয়ে ঠাঁই নেয় ১০ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু। জুলাই মাসে জর্দান সীমান্তবর্তী সিরীয় শহরে গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে জর্দানেও শরণার্থীর ঢল শুরু হয়। অক্টোবরে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের মদদপুষ্ট মিলিশিয়াদের হাতে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি উৎখাত ও নিহত হলে ক্ষমতার শূন্যতাকে কেন্দ্র করে সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং অচিরেই ইউরোপে যাওয়ার পথ খুলে যায়। ওদিকে ২০১২ সালের এপ্রিলে কুর্দি বংশোদ্ভূত সিরীয় উদ্বাস্তুরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় উত্তর ইরাকের প্রায় স্বাধীন কুর্দিস্তানে আসতে শুরু করে। ওখানকার দুহকের কাছে দোমিজে ইরাকের বৃহত্তম সিরীয় উদ্বাস্তু শিবির গড়ে উঠেছে। ২০১২ সালের জুলাইয়ে তুর্কী সীমান্ত থেকে ৩০ মাইল দূরে সিরিয়ার আলেপ্লোয় লড়াই তীব্রতর রূপ ধারণ করলে আরও দুই লাখ সিরীয় নাগরিক পালিয়ে যায়। মে মাসে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গ্রীসে গেলে এথেন্স উদ্বাস্তু ঠেকাতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়। ২০১৩ সালের মার্চে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। সরকারী বাহিনী আলেপ্লোয় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করলে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়। সিরীয় উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লাখ। অক্টোবরে লিবিয়া থেকে ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া ও ঘানার দেশান্তরী লোককে নৌযানে করে ইতালি নেয়ার পথে সাগরে নৌযান ডুবে ৩৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়। এরপর থেকে প্রায়ই নৌযান ডুবে শরণার্থীরা মারা যেতে থাকে। ২০১৪ সালের জুনে আইসিসের উত্থান ঘটে। তারা ইরাকের মসুল দখল করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে। লাখ লাখ লোক মসুল ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে পালায়। জুনের শেষ নাগাদ জাতিসংঘের হিসাবে ঘড়বাড়ি ছাড়া ইরাকীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখ। সেপ্টেম্বরে আইসিস সিরীয়-তুর্কী সীমান্তের কাছে কুর্দি গ্রামগুলোতে আক্রমণ শুরু করলে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সিরীয় কুর্দি পালিয়ে যায়। অক্টোবরে আইসিস তুর্কী সীমান্তের কাছে সিরিয়ার কোবানি শহর অবরোধ করলে গণহারে দেশান্তর শুরু হয়। প্রায় চার লাখ সিরীয় কুর্দি তুরস্কে পালিয়ে যায়। এখানকার সুরুক শহরের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। নবেম্বরে ইতালি দক্ষিণ ভুমধ্যসাগরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান বন্ধ করলে দেশান্তরীদের মৃত্যু সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল লিবীয় উপকূল থেকে ৭০ মাইল দূরে ভূমধ্যসাগরে নৌযান ডুবে ৮শ’রও বেশি দেশান্তরী উদ্বাস্তু মারা যায়। জুন মাসে হাঙ্গেরি উদ্বাস্তুর ঢল ঠেকাতে হাঙ্গেরি-সার্বিয়া সীমান্তে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া তৈরির ঘোষণা দিলে ১০৯ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্ত বন্ধ হওয়ার আগেই তা পাড়ি দেয়ার জন্য প্রবলগতিতে জনস্রোত শুরু হয়। আগস্টে জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল সিরীয় উদ্বাস্তুদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার কথা ঘোষণা দিলে উদ্বাস্তুর ঢল আরও বেড়ে যায়। ইউরোপে এ পর্যন্ত সিরীয় ও অন্যান্য দেশের উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৩০ হাজার। যুদ্ধের বিভীষিকা, ধ্বংস ও সংহার সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিজের বসতবাড়ি এমনকি স্বদেশকে পেছনে ফেলে রেখে ভিনদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। অবশ্য বিশ্বময় উদ্বাস্তুর যে ঢল নেমেছে তার জন্য যুদ্ধ সিংহভাগ দায়ী হলেও আরও কিছু কার্যকারণ আছে। যেমনÑ জলবায়ু পরিবর্তন, পানি সঙ্কট ও অতি জনসংখ্যার চাপ। এই পরের কারণগুলোর জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কিছু কিছু সমাজের মানুষের পক্ষে জীবন রক্ষা করা বা টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা তখন স্থানান্তরিত হতে বা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বময় এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৩ শতাংশ অধিবাসী বা প্রায় ৭০ কোটি লোক নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে চায়। স্বদেশের যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাত কিংবা দুর্বিষহ জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা নতুন গৃহের সন্ধান করে অন্য কোথাও অন্য কোনখানে যেতে চায় যেখানে মিলতে পারে শান্তি, নিরাপত্তা ও সুখ। কিন্তু সত্যি কি তা মিলবে? সূত্র : টাইম
×