ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

মুস্তাফিজুর : যেতে হবে বহুদূর

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২১ অক্টোবর ২০১৫

মুস্তাফিজুর : যেতে হবে বহুদূর

বয়েস তাঁর কতই হবে? সবে উনিশ পেরিয়েছে। এই বয়সেই সে এখন রীতিমতো সুপারস্টার। অথচ মাস চারেক আগেও সে ছিল অনেকের কাছেই ছিল অচেনা। মাত্র ক’দিনেই কেবল গোটা বাংলাদেশ নয়, বলা যায় গোটা ক্রিকেট-বিশ্ব মাতিয়ে ফেলেছেন। এরই মধ্যে সে অনন্য ক্রিকেট রেকর্ডে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। কেবলমাত্র নিজেকেই নয়, নিজের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকেও তুলে নিয়ে গেছে কয়েক ধাপ ওপরে। নিজেই রেকর্ড গড়েছেন তা নয়, সে রেকর্ডে সামিল হয়েছে বাংলাদেশও। বলতে গেলে এরই মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন জয় এসেছে তারই হাত ধরে। এ কথা বললে অসঙ্গত হবে বলে মনে না যে তার কারণেই বাংলাদেশ এতটা সহজে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের পেছনে তার বড় অবদান ছিল। আর সেই দুটি জয় বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগের পথে এক ধাপ এগিয়ে রাখে না বলে বলা যায় অনেকটা নিশ্চিত করে। এতক্ষণ যার কথা বলছি তিনি এ সময়ের আলোচিত তথা ক্রিকেটবিশ্ব আলোড়িত সাতক্ষীরার মেধাবী তরুণ পেস-বোলার মুস্তাফিজুর রহমান সেটা বুঝতে নিশ্চয় কোন অসুবিধে হয়নি। এখন আর মুস্তাফিজুরকে চিনতে কোন বিশেষণের দরকার হয় না। যারা জানেন না বা ক্রিকেটের খবর তেমন একটা রাখেন না তাদের অনেকে ভাবতে পারেন, কী এমন কীর্তি গড়েছেন উনিশ পেরোনো ছেলে, যার জন্য এত স্তুতি? কী করেছেন না বলে বলা যায়, কী করেননি! ক্রিকেটের অনেকগুলো রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছেন। বাংলাদেশের তো বটেই এমন কী বিশ্ব ক্রিকেটেও এমন স্মরণীয় অভিষেক খুব কম ক্রিকেটারের হয়েছে। ওর শুরুটা স্বপ্নকেও হার মানিয়েছে। বাংলায় একটা কথা আছে, ‘রাজকীয় অভিষেক’। ঠিক তাই। এ বছর ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের বিপক্ষের একমাত্র টি-২০ ম্যাচে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় এ কৃতী বোলারের। ম্যাচ জেতা সে ম্যাচে মুস্তাফিজ বড় সাফল্য পাননি। তারপরও ৪ ওভার বল করে ২০ রানে ২ উইকেট নিয়ে আলোচনায় আসেন। এই ৪ ওভার বল করা দেখেই তার মধ্যে আলো দেখতে পান অনেকে। এরপর ১৮ জুন আসে মুস্তাফিজের জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভারতের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় মুস্তাফিজের। আর এই ম্যাচটিই ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চলে আসেন লাইম লাইটে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচে ৫০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে নাম লেখান। ওযান-ডে ক্রিকেটের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে তিনি এ রেকর্ড গড়েই থেমে থাকেননি মুস্তাফিজ। পরের ম্যাচে ৪৩ রানে ৬ উইকেট নিয়ে পর পর ২ ম্যাচে ৫ বা এর অধিক উইকেট নেয়ার এক অনন্য নজির গড়েন। ইতিহাসের অংশ হতে বুঝি মুস্তাফিজের খাতায় যোগ হওয়ার আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। তৃতীয় ম্যাচে আরও ২টি উইকেট পাওয়ায় অভিষেকে তো বটেই একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসে এক সিরিজে সর্বোচ্চ (১৩) উইকেট পাওয়ার এক অনন্য রেকর্ড গড়েন। এর আগে মুস্তাফিজ বাংলাদেশ দলের ওয়ান-ডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভ্যাসবার্ট ড্রেকসের ৩ ম্যাচে ১২ উইকেট লাভের রেকর্ড ভেঙে দেন। ৩ ম্যাচ সিরিজে ১৩ উইকেট পাওয়ার এমন কৃতিত্ব আর কোন বোলারের না থাকলেও ৫ ম্যাচ সিরিজে ১৩ উইকেট পাওয়া মুস্তাফিজের সতীর্থ আছেন মাত্র একজন। তিনি অস্ট্রেলিয়ান বোলার রায়ান হ্যারিস। হ্যারিস ৫ ম্যাচ সিরিজে ১৩ উইকেট লাভ করেন। রেকর্ড গড়ে ক্রিকেটে রাজকীয় অভিষেকের নজির বিশ্ব ক্রিকেটে তো বটেই বাংলাদেশেও অনেক আছে। অনবদ্য সূচনার চেয়ে বড় হচ্ছে অনবদ্যভাবে টিকে থাকা। টিকে থাকতে পারলেই একদিন সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো সম্ভব। দু’একটি রেকর্ড গড়ে ক্যারিয়ার থেমে গেলে সে রেকর্ড পূর্ণতা পায় না। বিশ্বক্রিকেটাকাশে তো বটেই বাংলাদেশেও অনেক স্বাতী, অনেক ধ্রুবতারার জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠার পর অনেক পতন আমরা দেখেছি। তারাবাজির মতো ফরফর করে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়ার দৃষ্টান্তও ক্রিকেটে ভূরিভূরি রয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটে তো এমন নজির ভূরি ভূরি রয়েছে। আমাদের দেশের দিকে তাকালেও দৃষ্টান্ত কম মিলবে না। রেকর্ড গড়ে ক্যারিয়ার শুরুর পর দু’মাস না যেতেই অনেকের নাম ভুলে যেতে পাঠকের সময় লাগেনি। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেন্সুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১৪৫ রানের অনুপম শতক হাঁকিয়ে দর্শকের মনে প্রত্যাশা জাগালেও পরে আর সে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মেলেনি। সম্ভাবনাময় বালক মোহাম্মদ আশরাফুল অভিষেক টেস্টে কম বয়সে শতরান করে রেকর্ড গড়ে ক্রিকেট জীবন শুরু করলেও ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে আজ ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত আশরাফুলের ক্যারিয়ার বলতে গেলে শেষ হয়ে গেছে। অভিষেক টেস্ট ইনিংসে ৮১ রানে ৬ উইকেট নিয়ে যাত্রা শুরু মঞ্জুরুলের খবর আজ অনেকের অজানা। অভিষেক টেস্টে দশ নম্বরে ব্যাট করতে এসে সেন্সুরি হাঁকিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া আবুল হাসানের কথা এখন অনেকেই ভাবেন না। অভিষেক টেস্টে সেন্সুরি আর হ্যাটট্রিকসহ ৫ উইকেট পাওয়া সোহাগ গাজীর এখন দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে লড়তে হচ্ছে। টেস্টে ইনিংসে ৬ উইকেট পাওয়া বাংলাদেশের একমাত্র বোলার মঞ্জুরুল ইসলামের পরে আর দলে জায়গা হয়নি। ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন পরপর তিন টেস্টে সেন্সুরি করে বিশ্বরেকর্ড করে টেস্ট জীবনের শুরু করলেও নারী কেলেঙ্কারি আর শ্রাচ ফিক্সিংয়ের অপবাদ কাঁধে নিয়ে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এ রকম ঘটনা আকছার রয়েছে। মুদ্রার যেমন দুই পিঠ থাকে তেমনি যে কোন শুরুরও দু’টো দিক। ভাল সূচনার দিক আর মন্দ শুরুর দিক। অসম্ভব ভাল সূচনার পর যেমন অনেকেই তেমন করে আর এগোতে পারেনি তেমনি খুব বাজেভাবে শুরুর পর শেষটা সফলতায় ভরা কাহিনীও ক্রিকেটে কম নেই। এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। ক্রিকেট লিজেন্ড ভারতের শচীন টেন্ডুলকরই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জীবনের প্রথম দু’ম্যাচে যে শচীন দু’টো ডাক মেরে সাঝঘরে ফেরেন সেই শচীনই পরে সর্বাধিক ম্যাচ, রান, শত রান, অর্ধশত রানসহ ক্রিকেটের অসংখ্য রেকর্ডের মালিক হন। এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নেরও। টেস্ট শুরুর প্রাক্কালে তার পারফর্মেন্স তেমন একটা ভাল না থাকলেও অবসরের আগে টেস্টে সর্বাধিক ৭০৮ উইকেট নেন এ কৃতী লেগস্পিনার। এ রকম দৃষ্টান্ত ক্রিকেটে ভূরিভূরি রয়েছে। ভাল শুরু বড় কথা নয়, ভালভাবে টিকে থাকাটাই বড় কথা। টিকে থাকলে একদিন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছানো সম্ভব। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেকগুলো জয়ের নায়ক মুস্তাফিজ। বেশ কয়েকটি সাফল্যের সফল রূপকার সে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এক নতুন সংযোজন। এক জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা। আগেই বলেছি, পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টি-২০ ক্রিকেট ম্যাচে তার অভিষেক। একদিনের সিরিজে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হলেও টেস্টে তার অভিষেক দ. আফ্রিকার বিপক্ষে। তিন দলের বিপক্ষে তিন রকম ক্রিকেটে অভিষেক। তিন দলের বিপক্ষেই নিজেকে প্রমাণ করেছে সে। পাকিস্তানের বিপক্ষে যদিও সে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’র পুরস্কার পায়নি তবে সেটা পুষিয়ে নিয়েছে ভারতের বিপক্ষে একদিনের সিরিজে। অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম এবং একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ৫০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার লাভ করেন। তার আগে ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ৩০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে জিম্বাবুইয়ের ব্রায়ান ভিটরি বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ভিটরি পরের ম্যাচেও ৫ উইকেট পেলেও মুস্তাফিজ এদিক দিয়ে আছেন এগিয়ে। তিনি পরের ম্যাচে আবারও ৪৩ রানে ৬ উইকেট লাভ করেন। আবারও রেকর্ড গড়ে ম্যাচ সেরা। জীবনের প্রথম দুই ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি। তৃতীয় ম্যাচে আরও দুই উইকেট নিয়ে ৩ ম্যাচ সিরিজের সর্বাধিক ১৩ উইকেট নিয়ে আবারও ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো। রেকর্ডের পর রেকর্ড। তাই বলে এখানেই থেমে থাকেনি মুস্তাফিজ-কীর্তি। ভারত মফর শেষে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। বৃষ্টিতে টেস্ট ম্যাচ বাতিল হলেও মুস্তাফিজের কীর্তিগাথা থেমে থাকেনি। প্রথম ইনিংসে ১৭.৪ ওভার বল করে ৬ মেডেনসহ ৩৭ রান খরচায় ৪ উইকেট লাভ করে নতুন ইতিহাস গড়তে না পারলেও তার এক জাদুকরি ৪-২-৬-৩ স্পেলের এক ওভারের ৪ বলে তিনি দ. আফ্রিকার হাশিম আমলা, জেপি ডুমিনি ও কুইন্টন ডি কককে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দিয়ে এই এক স্পেলেই ম্যাচের চাকা ঘুরয়ে দেন। দ. আফ্রিকা অল আউট হয় ২৪৮ রানে। বৃষ্টির কারনে টেস্ট পরিত্যক্ত হয়। খেলা হলে মুস্তাফিজের হাত ধরে বাংলাদেশই জিততো বলে অনেকে মনে করেন। তারপরও অমীমাংসিত এ ম্যাচের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’র পুরস্কার পান মুস্তাফিজ। অভিষেক ওয়ান-ডে ও অভিষেক টেস্টে ম্যাচসেরা হওয়ারও এক নতুন ইতিহাস গড়েন মুস্তাফিজ। এমন রেকর্ড আর কারো না থাকলেও অনেকটা কাছাকাছি রেকর্ড আছে বাংলাদেশের আরও একজনের। তিনি আরেক বাঁহাতি স্পিনার ইলিয়াস সানী। তিনিও অভিষেক টি-২০ ম্যাচে ও অভিষেক টেস্টে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’র পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ দুজন ছাড়াও অভিষেক টেস্টে ম্যাচ সেরার তালিকায় আরও আছেন জাভেদ ওমর বেলিম ও মোহাম্মদ আশরাফুল। মুস্তাফিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার কেবল শুরু। এখনও অনেক পথ বাকি। যেতে হবে বহুদূর। অনেক চড়াই-উরাই, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, খ্যাতির বিড়ম্বনাও অনেক আর পথটাও বড়ই পিচ্ছিল। চলতে হয় খুব সাবধানে। থাকে যে কোন মুহূর্তে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয়। পথভ্রষ্ট হওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যাও কম নয়। পরিসংখ্যানের বিচারে নাইবা গেলাম। একটা কথা বলে রাখি, পাহাড়চূড়োয় ওঠা যতটা কষ্টের তার চেয়ে কষ্টের সেখানে টিকে থাকা। অনেক ঠেলা, অনেক ঝড়-ঝাপটা সামলে সেখানে টিকে থাকতে হয়। সেটা যে করতে পারে শেষ জয়টা সেই পায়। এ কথাটা মনে রাখতে হবে মুস্তাফিজকে। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক [email protected]
×