ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ মামুন রশীদ

‘তোমার মার্জিত পোশাক পরা উচিত’

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২১ অক্টোবর ২০১৫

‘তোমার মার্জিত পোশাক পরা উচিত’

ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ^কাপটা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খেলেছিলেন। আর সেবারই প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খেলতেও গিয়েছিলেন লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকর। আগের বছর নিউজিল্যান্ড সফর করে ফেরার পরবর্তী বছর নবেম্বরে দীর্ঘ সফরে অস্ট্রেলিয়া যায় ভারতীয় ক্রিকেট দল। তরুণ শচীনের জন্য সেটা ছিল অনেক বড় শিক্ষণীয় এক সফর। যদিও নিউজিল্যান্ডে খেলে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন প্রায় একই কন্ডিশনে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে খেলার যোগ্যতা আছে তাঁর। কিন্তু উপমহাদেশের যে কোন ক্রিকেটার কিংবা যে কোন দলের জন্যই অস্ট্রেলিয়াতে খেলা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটা যখন নিতে আসলেন শচীন তখন দরজায় কড়া নাড়ছে ওয়ানডে বিশ^কাপ। টিম ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল একেবারে মর্যাদার ওই আসরে অবতীর্ণ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত খেলার জন্য। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ৫ টেস্টের সিরিজ খেলেছিল ভারত। ওই সিরিজেই অসি আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার দারুণ সুযোগ ছিল শচীনসহ অন্যান্য তরুণ এবং টিম ইন্ডিয়ার সকল ক্রিকেটারের। ফরমেট আলাদা এবং স্বাদ ভিন্ন হলেও টেস্ট ক্রিকেট অগ্নিপরীক্ষা, সেই পরীক্ষায় সফল হতে পারলে তো কথাই নেই। বিশ^কাপে দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে তা বলাই বাহুল্য। এই দীর্ঘ সফরে অনেক মজাদার ঘটনাই বর্ণনা করেছেন শচীন তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’-তে। তারই একটি শচীনের কাছের বন্ধু বিনোদ কাম্বলিকে নিয়ে। কিম্ভূতকিমাকার পোশাক পরিধানের জন্য ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল তাঁকে। ভারত ক্রিকেট দলের ম্যানেজার রণবীর সিং মহেন্দ্র তাঁকে অনেকের সামনেই বলেছিলেন, ‘কেন তুমি ভাঁড়ের মতো পোশাক পরেছো? তুমি ভারতের হয়ে খেলছো। তোমার অবশ্যই কিছু ভদ্রোচিত এবং মার্জিত পোশাক পরা উচিত।’ ১৯৯১ সালের নবেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে আসার পর ৫ টেস্টের সিরিজে নাকানি-চুবানি খায় ভারত। একমাত্র তৃতীয় টেস্টে কিছুটা ভাল খেলে ড্র করতে পারে। সেটাও ছিল শচীনের তখন ক্যারিয়ারসেরা অপরাজিত ১৪৮ রানের সুবাদে। অবশ্য রবি শাস্ত্রীর ২০৬ রানটা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাকি চার টেস্টেই খুব বাজেভাবে হেরে যায়। বিশ^কাপ শুরুর এক সপ্তাহেরও বেশি আগে সিরিজ শেষ হয়ে যায়। তবে ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসেনি। অনুশীলন করে, ঘুরে বেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশে পুরোপুরি খাপ খেয়ে ওঠার জন্যই এমন ব্যবস্থা নিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। অবশ্য টেস্ট সিরিজে দারুণ মজার একটি ঘটনা ব্যাখ্যা করেছেন শচীন। তখন টেস্ট দলের মধ্যে সবচেয়ে রোগা-পটকা ছিলেন বাঁহাতি স্পিনার ভেঙ্কটপতি রাজু। অপরদিকে, অস্ট্রেলিয়ার বিশাবপুর অধিকারী ক্রিকেটার ছিলেন মার্ভ হিউজ। তাঁর চওড়া মোটা গোঁফ পুরোপুরি ভীতিকর অনুভূতি এনে দিত। বিশালদেহী মার্ভ অবশ্য খাওয়ার প্রতিই বেশি মনোযোগী থাকতেন এবং আকার-আকৃতিতে বিশাল হলেও আচরণে ছিলেন অমায়িক। সেটা বোঝা গেল যখন রাজু একটা কা- করে বসলেন। রোগা-পটকা রাজুকে ‘টিম ইন্ডিয়ার’ বাকি ক্রিকেটাররা ফুঁসলিয়ে মার্ভের গোঁফ ধরে টানার জন্য রাজি করে। সেটি ছিল পার্থে পঞ্চম টেস্ট খেলতে উভয় দলের বিমান যাত্রার সময়। একই বিমানে উভয় দল যাচ্ছিল। রাজু গিয়ে মার্ভের গোঁফ ধরে টান দেন, তবে মার্ভ অমায়িক হেসে সেটাকে খেলোয়াড়ি মনোভাবেই গ্রহণ করেন। তবে রাজু সেদিন থেকে দলে ‘মহাবীর’ তকমা পেয়ে যান। সবাই তাঁর প্রশংসা করেন। বিশ^কাপ এগিয়ে আসছিল। টিম ইন্ডিয়ার ক্রিকেটাররা টেস্ট সিরিজে বেশ বাজেভাবে হেরে গেলেও বেশ আনন্দেই সময় কাটাচ্ছিল। অনুশীলন আর ঘোরাঘুরি করেই দিনাতিপাত। বন্ধু কাম্বলির সঙ্গে এক কক্ষেই থাকতেন তরুণ শচীন। আর কাম্বলি সবসময় পাশাপাশি থাকার কারণে দারুণ উপভোগ করছিলেন তিনি সময়গুলো। তাছাড়া সবাই সবার সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছিলেন। পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছিল। তাছাড়া দলের ফিজিও ড. আলী ইরানি ছিলেন দারুণ মানুষ। তিনি ক্রিকেটারদের তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে নিজেই চা বানিয়ে খাওয়াতেন। আর তাঁর চা ছিল বিশেষ ধরনের চিনি দিয়ে তৈরি যার স্বাদটাই হতো অন্যরকম। লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে সঙ্গে করে শচীন এমন একদিন চা খেতে যাওয়ার পর ইরানির সঙ্গে বেশ জমিয়ে আড্ডা চলছিল। মাঝে একটি ফোন আসলে ইরানি কথা বলেই অদ্ভূত ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘একদিন তোমরা আলী ইরানির কথা ভাববে যে প্রায়ই দারুণ চা বানিয়ে খাওয়াতো এবং আমাদের যতœ নিত।’ হিরওয়ানি তাঁর এ কথায় দারুণ মজা পেয়ে জানান টিম ম্যানেজার রণবীর প্রায়ই বলেন, ‘তুমিতো যখন-তখন ডবল সেঞ্চুরি করে ফেলো ম্যানেজারের সুদৃষ্টিতে থাকার কারণে। ভারতীয় দলে তোমার নামই সবার আগে আসবে এবং এরপর বাকিরা তালিকায় থাকবে।’ সময়গুলো বেশ কাটছিল। কাম্বলি মানুষ হিসেবে শচীনের কাছে দারুণ হলেও তাঁর কিছু সমস্যা ছিল। আর সেই সমস্যার মধ্যে অন্যতম ছিল পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানে। অদ্ভুত ধরনের কিছু কিছু পোশাক পরিধান করতেন মাঝে মাঝেই কাম্বলি। সেজন্য তাঁকে কথাও শুনতে হয়েছে। কাম্বলি সবসময় রংচংয়ে, উজ্জ্বল এবং কটকটে পোশাক পরতেন যা ঝলমল করত এবং রোদে ঝিকিয়ে উঠে যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এমন ধরনের পোশাক সাধারণত কোন আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই পরিধান করে মানুষজন। কিন্তু সেটা ছিল কাম্বলির জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এভাবে দেখতে দেখতে একদিন দলের ম্যানেজার রণবীর বলেন, ‘তুমি এমন ভাঁড়ের মতো পোশাক পড়ো? মনে রেখো তুমি ভারতীয় দলের হয়ে খেলো। ভদ্র, মার্জিত কিছু পোশাক বেছে নাও পরার জন্য।’ তবে কথাটা যখনই শুনেছেন সঙ্গে সঙ্গেই কাম্বলি অন্য কান দিয়ে বেরও করে দিয়েছেন। কারণ রণবীরের কথা শুনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি কাম্বলির মধ্যে। তিনি তাঁর মতো করেই পোশাকগুলো পরে বেরিয়েছেন। টেস্ট সিরিজ ও বিশ^কাপ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ মাস সেবার অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন শচীন। ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া, মৌলিক এবং শিক্ষামূলক একটি সফর ছিল সেটা এমনটাই দাবি করেছেন লিটল মাস্টার। তথ্যসূত্র : শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘ প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে।
×