ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৬ চৈত্র ১৪৩০

দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি;###;এদের অধিকাংশই কোন না কোন কাজে যুক্ত, দৈনিক ন্যূনতম আয় ২০০ টাকা;###;পরিবারই স্কুলে ভর্তির অন্তরায় বলে মনে করে শিশুরা;###;আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে অসংখ্য ফ্রি স্কুলিং

সিন্ডিকেটের ফাঁদে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২২ অক্টোবর ২০১৫

সিন্ডিকেটের ফাঁদে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ বাস্তবে রাস্তাঘাটে পথশিশু থাকলেও এদের অধিকাংশই কোন না কোন কর্মে ব্যস্ত। কারও হাতে বেলুন, কেউবা বিক্রি করছে ফুল। কর্মের সঙ্গে যুক্ত এমন শিশুদের দিনে আয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। অন্তত বিশজন পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পথকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা শিশুদের ন্যূনতম ২০ শতাংশ কোন না কোনভাবে যুক্ত রয়েছে লেখাপড়ার সঙ্গে। তবে জনকণ্ঠের দীর্ঘ এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পারিবারিক অসচ্ছলতাকে পুঁজি করে দুই থেকে তিন বছরের শিশুকেও ঠেলে দেয়া হচ্ছে কোন না কোন কর্মে। আর ওই সব পরিবারের কারোরই মাথার ওপর চালা নেই। তবে পরিবারগুলো অদৃশ্য এক সিন্ডিকেটের ফাঁদে আটকে আছে বলে মত মানবাধিকারকর্মীদের। নগরী ঘুরে দেখা গেছে, আগের যে কোন সময়ের চেয়ে কমে এসেছে পথশিশুর সংখ্যা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন বাড়ছে ছিন্নমূল পথশিশু। রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুদের একটি বড় অংশও জড়িয়ে আছে মাদকের সঙ্গে। শুধু মাদক নয়, যুক্ত হচ্ছে অপরাধকর্মেও। সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে যাওয়া ছাড়াও মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্রের বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ওই সব শিশু। নগরীর সর্বত্রই এদের দেখা গেলেও জনাকীর্ণ রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পটে অহরহ বিচরণই বেশি। সর্বশেষ তথ্যমতে দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালের গবেষণার এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ পথশিশু রয়েছে। আর ঢাকার পথে বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা ৭ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ দেশে পথশিশুর সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪। আর ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০। অন্যদিকে শিশুদের নিয়ে কাজ করা শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, সারাদেশে ১০ লাখের অধিক পথশিশু রয়েছে। আর খোদ ঢাকায় এ সংখ্যা চার লাখের উপরে। তবে পথশিশুর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ অনেকটা অসম্ভব বলে মনে করেন শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ঠিক কত পথশিশু রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আর পথশিশুদের নিয়ে পরিসংখ্যান করা অনেকটা অসম্ভব ও কঠিন কাজ। কারণ এরা একেক দিন একেক স্থানে একেক রাস্তায় থাকতে ভালবাসে। সাধারণত এদের দুই থেকে তিনজন দলে দলে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নগরীর সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। আজ এখানে, কাল সেখানে। আর দেশে যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ নেতিবাচক শব্দ পথশিশু ॥ পথশিশু নিয়ে কাজ করা সচেতন তরুণ প্রজন্ম ও মানবাধিকারকর্মীরাও ‘পথশিশু’ শব্দটিকে নেতিবাচক বলে মনে করেন। এদের অধিকাংশই ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু’ শব্দটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, পথকে কেন্দ্র করে যারা জীবিকা সংগ্রহ করে বা পথের কোন এক জায়গায় বসবাস করে প্রচলিত অর্থে তাদেরই পথশিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু’ শব্দটি অধিক গ্রহণযোগ্য বলে আমার মনে হয়। আর শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদও একই মত পোষণ করে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে’ পথশিশু শব্দটি নেতিবাচক। শব্দটি ব্যবহার করতে আমি নিজেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। শিশু বলতে সব শিশুই এক ও অভিন্ন। শব্দটির বিকল্প সুন্দর ও শোভনীয় সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য ও অর্থপূর্ণ শব্দ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ তাঁর মতে, শব্দটির মাধ্যমেই একটি শ্রেণী বিভেধ তৈরি হয়ে রয়েছে, যা অনেকটা অকাম্য। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন সচেতন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পথশিশু শব্দটি তাদের অপছন্দের, বরং ‘সুবিধাবঞ্চিত শিশু’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা। ঠিক তেমনি একজন প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত পাভেল বাবু। শিশুদের নিয়ে কাজ করা এ তরুণ জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি পথশিশু শব্দটি পছন্দ করি না। বরং ওদের সুবিধাবঞ্চিত শিশু বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশু বলতে কেবল পথকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা বা আয় করে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকা শিশুকে বোঝায় না। শব্দটি নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও হাজারে দুই বা তিনটি শিশুরও জন্ম পথে হয় না। এমন ধারণা আব্দুস শহীদ মাহমুদেরও। আর মহাখালীর রেলক্রসিং সংলগ্ন ফুটপাথে দীর্ঘ সাত বছর ধরে কাজ করা এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনান, আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় কোন শিশুকে পথে জন্ম হতে দেখিনি! আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, তবু ওদের নাম পথশিশু! এক প্রশ্নের জবাবে এলিনা খানও বলেন, কোন না কোন কারণে পথে শিশুর জন্ম হতে পারে। যেমন নদী ভাঙ্গনের ফলে কোন গর্ভবতী বাসস্থান হারিয়ে রাস্তাকে আবাসস্থল করতে বাধ্য হয়, সেক্ষেত্রে শিশুটির ডেলিভারি রাস্তায়ও হতে পারে। তবে এককথায় পথশিশুর সংজ্ঞাটি ডিফিকাল্ট (কঠিন)। পরিবারই স্কুলে ভর্তির অন্তরায় ॥ জনকন্ঠের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব শিশু পরিবারকেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার অন্তরায় মনে করে। ঠিক তেমন একজন জাকিয়া। ৮ বছরের পথশিশু জাকিয়ার ভাষ্য, ‘রাস্তায় ফুল বিক্রি করি। দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। ফুল বেচে পেট চালাই।’ বুধবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে রাত ৯টায় কথা হয় শিশুটির সঙ্গে। স্কুলে পড়ে কিনা- এমন প্রশ্নে তার উত্তর, আগে পড়তাম। এহন ছাইড়া দিছি। কেউ স্কুলে নিয়ে পড়ালে পড়ব। শিশুটি আরও জানায়, ‘ঈদের আগে ফুলের বেচাকেনা ভাল ছিল, এখন বিক্রি কম। কোন দিন এক শ’ টাকাও আয় হয় না। বেশিরভাগ সময় না খেয়ে থাকি। মায়ের সাথে ভ্যানে রাত কাটাই।’ ঠিক একই সময় জাতীয় জাদুঘরসংলগ্ন ফুটপাথে কথা হয় জাকিয়ার মা রোজিনার সঙ্গে। রোজিনা জানান, ‘স্কুলে কিভাবে পড়াব? ফুটপাথে থাকি! টাকা নেই বলেই তো ভ্যানে আছি। আরও দুটো ছেলেমেয়ে আছে। বাধ্য হয়েই ফুটপাথে দিনযাপন করছি।’ তবে স্কুলে ভর্তি প্রসঙ্গে পথশিশু জাকিয়ার ভাষ্য, ‘মা ভর্তি করাইব না।’ শনিবার দুপুর দেড়টা। শাহবাগ ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে কথা হয় পথশিশু আঁখির সঙ্গে। আঁখি রুটি খেতে খেতে জনকণ্ঠকে বলে, দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই খাওয়া-দাওয়া চলে। তবে তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাকিয়া ও আঁখি সহোদর বোন। বাবা জাহাঙ্গীর ভ্যান চালানোর কথা বললেও ধারণা করা হয় তিনি মূলত ফুল ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত। ভ্যানে থাকার কথা বলা হলেও আঁখি জানায়, রাতে তারা কিছুটা সময় ভ্যানে থাকলেও কামরাঙ্গীরচরের পান্না ব্যাটারিসংলগ্ন এলাকায় তাদের বসবাস। অন্যদিকে বুধবার রাতে যে ভ্যানে জাকিয়া ও আঁখির মা রোজিনা শুয়ে শুয়ে জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন শনিবার দেখা গেছে, সে ভ্যানে ভিন্ন দুই মহিলা ফুল গাঁথছিলেন। আর শনিবার ওই ভ্যানের আশপাশে রোজিনাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে দেখা গেছে, দুই মহিলা ভ্যানে বসে ফুল গাঁথার সময় একজন পুরুষ তাদের পাহারা বা সঙ্গ দিচ্ছেন। শনিবার পুলিশ বক্সের সামনে পথশিশু আঁখির সঙ্গে কথা বলার সময় এ প্রতিবেদক ও আঁখির কথোপকথন শুনছিলেন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্মের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। দীর্ঘ তিন মাস পথশিশু নিয়ে কাজ করেছেন এমনটা জানিয়ে মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মেয়েটির কথা কিছুটা অসংলগ্ন। হয়ত পারিবারিক কারণে সত্য বলতে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। আর এরা সত্যিকারার্থে পথশিশু নয়, বলা যায় সৃষ্টিকৃত পথশিশু। পরিবারের কাছে এদের ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানের টাকা-পয়সার প্রলোভনটা বেশি। এজন্য স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও পারিবারিক অসচ্ছলতার কথা বলে এদের স্কুলে পাঠানো হয় না। যুক্ত করা হয় নানা কর্মে।’ একই দিন শনিবার দুপুর দুটোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন শহিদুলের চায়ের দোকানের সামনে কথা হয় পথশিশু বৃষ্টি ও ভাবনার সঙ্গে। বৃষ্টি ও ভাবনা কোন এক অজানা কারণে একে অপরের ওপর হেলেদুলে পড়ছিল। এমনকি ভাবনা বৃষ্টির চুল ধরেও টানাটানি করছিল, ওদের আচরণ অন্য আট-দশটা শিশুর মতো নয়। বৃষ্টি জনকণ্ঠকে জানায়, তার আয় দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। মায়ের নাম জানলেও শিশু দুটি বাবার নাম জানে না। এদের দেশের বাড়ি ফরিদপুর, থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পলিথিনের ঘুপচিঘরে। শিশু দুটি জানায়, মা হাছিনা পরিত্যক্ত বোতল সংগ্রহ করে পরিবার চালান। স্কুলে ভর্তির প্রসঙ্গে বৃষ্টি বলে, ‘স্কুলে ভর্তি হলে মা মারবে।’ প্রতিবেদকের সঙ্গে পথশিশুর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন চায়ের দোকানদার শহিদুল। স্কুলে ভর্তি হবে না এমন কথাটি বলার মুহূর্তে শহিদুল আচমকা বলে ওঠেন, ‘এরা ভিক্ষা করা ছাড়া কী আর করবে!’ পথশিশুরা পরিবারের প্রশ্রয়ে কর্মে জড়িয়ে যাচ্ছেÑ এমন বিষয়টি মানতে নারাজ মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান। তিনি বলেন, খেয়েপরে বেঁচে থাকতে শিশুরা কর্মে জড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে তাদের আবেগকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর দালাল মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে, যাদের কাছে শিশুদের পরিবারগুলোও জিম্মি হয়ে আছে। কর্মে যুক্ত থেকে স্কুলে পড়ে ॥ বুধবার রাত সাড়ে ৯টা। কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারা থেকে পান্থপথমুখী রাস্তায় কথা হয় পথের শিশু শিখা ও হাওয়ার সঙ্গে। ১০ বছরের শিশু হাওয়া বেলুন বিক্রি করলেও স্কুলে লেখাপড়া করে। সে জানায়, ‘পরিবারের অপারগতার কারণে বেলুন বিক্রি করছি। স্কুলেও পড়ি। পেপারে ছবি দিলে মাইনষ্যে দেহে। কয়, তোর ছবি! পরে হেই মাইনষ্যে শরম দেয়। এক ভাই বলছে আর কাউকে যেন ছবি তুলতে না দেই।’ শিখা ও হাওয়া সর্বদাই একসঙ্গে থাকে। মাস ছয়েক আগেও শিখার সঙ্গে জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। আর বুধবার রাতে শিখা বলে, ‘অনেকেই জিগায় তোমার ছবি তুইল্যা কোন টাকা দিছে? তোমার ছবি অনেক সুন্দর হইছে। কিন্তু এর পরে আর কোন ছবি তুলবা না।’ শিখা ও হাওয়ার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা বলার সময় বসুন্ধরা সিটির স্যামসাং শোরুমে কর্মরত তিন কর্মজীবী আবদুল্লাহ, রাজন ও ফয়সাল উন্মুখ হয়ে কথা শুনছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মোঃ আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, পথশিশুর ছবি তুলে তেমন কোন উপকার হয় না। এদের নিয়ে সবাই মজা নেয়, আফসোস করে। হয়ত ওদের পরিবারের অপারগতা আছে বলেই রাস্তাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। আমরা প্রায়ই এদের বসুন্ধরা সিটির সম্মুখে দেখি। হয়ত স্কুলে গিয়েও ভাল খানা দানা পাচ্ছে না বলেই বেলুন বিক্রি করে কিছু আয় করার চেষ্টা করছে। একই দিন রাত ১০টায় ফার্মগেটে কোন পথশিশু এ প্রতিবেদকের নজরে না আসলেও সাড়ে ১০টায় মহাখালীতে কথা হয় তিনটি পথশিশুর সঙ্গে। মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে পান-সিগারেট বিক্রি করছিল ১২ বছরের শিশু সোহেল। রাস্তায় বাস করতে না হলেও তার বসবাস মহাখালীর রেলগেট সংলগ্ন বস্তিতে। সোহেল জনকণ্ঠকে বলে, দিনে ২ থেকে ৩শ’ টাকা আয় হয়। নিজেও খাই, বাড়িতেও দেই। পান-সিগারেট বেচাকেনার অবসর সময়ে ফ্রি স্কুলিং এ ভর্তি হবে কিনা এমন প্রশ্ন করলে শিশুটি হাসতে হাসতে জানায়, ‘বাবা চাইলে ভর্তি হব।’ উল্টো প্রশ্ন করে, ‘স্কুলে পড়তে কি টাকা লাগবে?’ জানা গেছে, নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় এসেছে এ শিশু। তার বাবা সিএনজি চালক। আর রাত ১১টায় মহাখালী রেলগেটের পাশে পান সিগারেট বিক্রি করছিল ১০ বছরের একটি মেয়ে। শিশুটি নাখালপাড়ার একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সম্মানহানী হতে পারে এমন কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিশুটি জানায়, বাবা ভাত খাইতে গেছে, এ জন্য দোকানে বসছি। ঠিক তার পাশে আমড়া বিক্রি করছে ১২ বছর বয়সী তার বড় ভাই আব্দুর রহমান। শিশুটি জানায়, নারায়ণগঞ্জ কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করি। মাঝেমধ্যে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করি। তবে এ শিশুরা বাবা-মায়ের শেখানো মন্ত্রে যাই বলুক টানা দুদিন ঘটনা ঘেঁটে দেখা গেছে দিনের কোন না কোন সময় এরা পান-সিগারেট ও আমড়া বিক্রির সঙ্গে যুক্তই রয়েছে। একই স্থানে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় আবারও খোঁজ নেয়া হলে দেখা যায়, যে স্থানে ১০ বছরের মেয়েটি পান-সিগারেট বিক্রি করছিল সেই দোকান চালাচ্ছে তার মা। আর ভাই আবদুল্লাহর স্থানে আমড়ার দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল ওই মেয়েটি। শিশু আবদুল্লাহ ও ওই মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণেই শিশু দুটিকে দিয়ে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ পরিবারের মতো একই ঘটনা শহরের অধিকাংশ স্থানে চোখে পড়ে। একই স্থানে কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ রাস্তার শিশু সৃষ্টিকৃত পথশিশু। এ প্রসঙ্গে মহাখালী রেল ক্রসিং সংলগ্ন এক দোকানীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি দীর্ঘ সাত বছর ধরে ফুটপাথে ব্যবসা করছেন। যদিও একেক সময় একেক ব্যবসার সঙ্গে তিনি যুক্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ দোকানী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত পথে বা রাস্তায় কোন শিশুর জন্ম হয় না। যদি কোন কারণে এরূপ হয় তবে সন্তানের জন্মটি অবশ্যই হাসপাতালে হয়ে থাকে। আমার দীর্ঘ সাত বছরের অভিজ্ঞতায় পথে কোন শিশুর জন্ম হতে দেখিনি। তবে অনেক শিশুই অভিমান কিংবা রাগে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। পরবর্তী সময়ে তারাই পথশিশু নামে পরিচিতি পায়।’ অপরাধকর্ম ॥ নিত্য-নৈমত্তিক কর্মছাড়া পথের শিশুরা জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপরাধে। মাদক, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক কর্মে এ শিশুদের ব্যবহার অহরহ। এরা নানা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, পথকে কেন্দ্রকে যাদের বেড়ে ওঠা এদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে এদের রাজনৈতিক কাজেও ব্যবহার করা হয়। মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও অবৈধ অস্ত্রের মজুদও ক্ষেত্রবিশেষে এদের কাছে রাখা হয়। আর সাময়িক সময়ের জন্য মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এদের কাছে রাখা নিরাপদ। যা আইনের ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধ হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। একই বিষয়ে এলিনা খান বলেন, পথশিশু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি নিজেই অনেক সময় দেখেছি ওদের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হচ্ছে। নেশায় জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক ধরনের সিন্ডিকেট আছে, রাস্তায় থাকা পরিবার ওই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এজন্য তিনি ভদ্রবেশি মুখোশধারী ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই দায়ী করেন। পথশিশুদের নিয়ে ফ্রি স্কুলিং ॥ পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন, মজার স্কুল, বাংলাদেশ অদম্য ফাউন্ডেশন, পরিবর্তন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, লাইটার। মূলত এগুলো ফেসবুক ভিত্তিক ও তরুণ প্রজন্মের গড়ে তোলা সংগঠন। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য বড় বড় প্রতিষ্ঠান। যেখানে আসছে মোটা অঙ্কের ডোনেশন। তবে দাবি করা হয় পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই তেমন একটা জবাবদিহিতা নেই। পথশিশুদের নিয়ে স্কুল গড়ে তুলেছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হয়। প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন তার একটি। সামগ্রিক কার্যক্রম প্রসঙ্গে প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ইকরাম উদ্দিন আবিরের সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এক সময় বস্তির প্রতি খুব অনীহা ছিল। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাদের সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না। আর যা ছিল তা নেতিবাচক। আদমশুমারি সংক্রান্ত একটি কার্যক্রমে অংশ নেয়ার পর আমার পুরো ধারণা পাল্টে যায়। শুরু করি প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন। জানা গেছে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি অন্তত ১০০ পথশিশুর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করছে। দুটি শাখায় বর্তমানে এসব শিশুদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ক্লাস নিয়ে থাকেন। তেজগাঁও শিল্প এলাকার বেগুনবাড়ি সিদ্দিক মাস্টার ঢাল ও বাবুবাগ রেল লাইনের পাশে তাদের ফ্রি স্কুলিং কার্যক্রম চালু রয়েছে। লেখাপড়ার সমস্ত সামগ্রী ফ্রি দেয়ার পাশাপাশি শীতের সময় শীত বস্ত্র ও ঈদের সময় নতুন জামা কাপড় বিতরণ তাদের অনেকটা নিত্য-নৈমত্তিক কার্যক্রম। ২০১৩ সালে প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সফলতাও বেশ, বহু পথশিশুকেই কিছুটা হলেও অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এক প্রশ্নের জবাবে আবির বলেন, ‘সফলতার জন্য নয়, আত্মতৃপ্তি থেকেই আমরা কাজ করছি। অনেক ডোনারই সামনে আসতে চান না, তবে নীরবে নিভৃতে আমাদের সাহায্য করছেন। বর্তমানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে পথশিশুরা যাতে আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে পিএসসি পরীক্ষা দিতে পারে সে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।’ একই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত পাভেল বাবু বলেন, বহু টোকাইকেও আমরা খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। এটাই আমাদের বড় সফলতা। আর স্কুলিং কার্যক্রমতো অব্যাহত রয়েছেই। আর আমাদের প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা রয়েছে। অন্যদিকে সাভার ব্যাংক টাউনে পরিচালিত পরিবর্তন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক শ’ পথশিশু ও ওই অঞ্চলের দরিদ্র শিশুদের নিয়ে স্কুলিং প্রোগ্রাম চালু করেছে। ৩ বছর যাবত সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেয়ার পর শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তাদের এ কার্যক্রম। ফাউন্ডেশনের একজন সদস্য আবু হানিফ অপু জনকণ্ঠকে বলেন, সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে পথশিশু ও এ এলাকার দরিদ্র শিশুদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে আমরা চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস নিচ্ছি। মূলত তরুণ প্রজন্ম হিসেবে দেশের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এ কার্যক্রম। অনেকেই সাহায্যের আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে তারা আর কোন খোঁজ রাখে না! তবু আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই। ফেসবুক ভিত্তিক আরেকটি সংগঠন লাইটার। তারাও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে। লাইটারের সঙ্গে যুক্ত নাহিদ হাসান হিমু বলেন, পথশিশুদের নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন কাজ করছি। আমাদের স্কুলিং প্রোগ্রাম রয়েছে। আর জবাবদিহিতা তো আছেই। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহে স্বেচ্ছা শ্রমে পরিচালিত পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য জামান পায়েল প্রতিষ্ঠান করেছেন ঘাসফুল শিশু নিকেতন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পথশিশু নিয়ে কাজ করলেও এ মুহূর্তে কাজ করার সামর্থ্য নেই। কারণ অন্ন ও বাসস্থানই ওদের আগে দরকার। এ মুহূর্তে নানা কারণে আমাদের কার্যক্রম প্রায় থেমে যাচ্ছে।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পথশিশু নিয়ে কাজ করা অধিকাংশ সংগঠনেরই তেমন কোন জবাবদিহিতা নেই। এমনকি অনেকের নেই কোন নিবন্ধন। আর নিবন্ধন না থাকায় শিশু পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হয় বাংলাদেশ অদম্য ফাউন্ডেশনের কয়েকজন কর্মী। যা নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। পরে অবশ্য এরা জামিনে মুক্ত হয়েছেন। ফলে বলা যায়, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাবে পথশিশু নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনাও রয়েছে! পথশিশু নিয়ে কাজ করা এনজিও সংস্থা ও তরুণ প্রজন্মের গড়ে তোলা বিভিন্ন স্কুলের জবাবদিহিতা নিয়ে জনকণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে এলিনা খান বলেন, তরুণদের ভয়কে জয় করার মনোবৃত্তি থাকতে হবে। এদেশের স্বাধীনতাও তারুণ্যের অর্জন। ভাল কাজ করতে গেলে বাঁধা আসবে, বিপত্তি আসবে। কাজ করতে গিয়ে আমরাও নানা সময়ে নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। তবু থেমে নেই। ফেসবুক ভিত্তিক ও সংগঠিত হয়ে তরুণরা যে কাজটি করছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তিনি আরও বলেন, সংগঠিত হয়ে করা মানে কোন সংগঠন নয়, নামকরণ করে সংগঠন ভিত্তিক যখন কিছু করা হয় তখন প্রকাশ্যে তার তথ্য প্রদান ও জবাবদিহিতা থাকা বাঞ্ছনীয়। ৮ থেকে ১০ লাখ শিশুকে বর্তমান বাংলাদেশে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয় বলে মনে করেন শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ। তিনি জনকনণ্ঠকে বলেন, ‘সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করা গেলে মাত্র ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে পথের সব শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে তার জন্য অবশ্যই সরকারী ও বেসরকারী প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
×