ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ॥ বারো জনের হাতে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২২ অক্টোবর ২০১৫

পেঁয়াজ॥ বারো জনের হাতে

এম শাহজাহান ॥ বারো জনের সেই সিন্ডিকেটের কব্জা থেকে মুক্ত হতে পারছে না পেঁয়াজের বাজার। কোরবানির পর চাহিদা কমলেও কমছে না দাম। জাত ও মানভেদে এখন দেশী পেঁয়াজ ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত দেড় থেকে দুই মাস ধরে অস্বাভাবিক দামে স্থিতিশীল রয়েছে পেঁয়াজের বাজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটাই ওই ১২ সিন্ডিকেটের কারসাজি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ। পর্যাপ্ত মজুদ, স্বাভাবিক আমদানি এবং সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি না থাকার পরও দাম কমার কোন লক্ষণ নেই। শীঘ্র দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে সেই আলামতও পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন। এছাড়া দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ভারতে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ছে। সামনে কালীপূজা রয়েছে। ফলে এই পণ্যটির দামও বাড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা ভারতের দোহাই দিয়ে আরেক দফা পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। সূত্রমতে, পেঁয়াজসহ প্রধান ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া নামমাত্র শুল্ক পরিশোধ করতে হয় রসুন আমদানিতে। এক্ষেত্রে শুল্ক রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। আদা ও হলুদ আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। পামঅয়েলে ২০, সয়াবিনে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে। নিত্যপণ্যের সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখতে আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বন্দর থেকে দ্রুত পণ্য খালাসের জন্যও বাড়তি সুবিধা পান আমদানিকারকরা। ফলে গত এক বছরে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত আমদানির ফলে সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রয়েছে। শুধু চাহিদা ও যোগানের পার্থক্য হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা এবং সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর অনৈতিক তৎপরতার কারণে অস্বাভাবিক রয়েছে পেঁয়াজের দাম। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সেই বারো সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট সম্পর্কে খোদ সরকারও জানে। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিতেও এটি চিহ্নিত রয়েছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে ঢাকার মৌলভীবাজার, শ্যামবাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং বেনাপোল, হিলি, ভোমরা ও কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর কেন্দ্রিক এই সিন্ডিকেট চক্র বরাবরই সুরক্ষিত রয়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকার আমদানি শুল্কমুক্ত বা সামান্য শুল্কে আমদানির সুযোগ দিলেও তার প্রতিফলন নেই বাজারে। ফলে সরকার সাধারণ মানুষের জন্য এ সুবিধা দিলেও লাভবান হচ্ছে মূলত ওইসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সিন্ডিকেট চক্রের কারণে পেঁয়াজের দাম কমছে না। দেশজ উৎপাদন এবং আমদানি যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে পেঁয়াজ ৭৫ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা নয়। এটা অস্বাভাবিক দাম। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের বারো জনের একটি সিন্ডিকেট চক্র চিহ্নিত করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাও এদের নজরে রেখেছে। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না আসায় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না বাজার মনিটরিং টিম। এদিকে, অতি বৃষ্টি ও মৌসুমী বায়ু অনুকূলে না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে রফতানি মূল্য দ্বিগুণ করেছে পেঁয়াজের প্রধান উৎস ভারত। দাম বৃদ্ধির এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেও বেড়ে গেছে মসলা জাতীয় এ পণ্যটির দাম। এছাড়া দুর্গাপূজার পাঠাবলি উৎসবে ভারতে এখন পেঁয়াজের দাম একটু বাড়তির দিকে রয়েছে। সামনে কালীপূজা আসছে। ওই সময়ও পাঠাবলি উৎসব করে থাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ। তখন প্রয়োজন হয় বাড়তি পেঁয়াজের। এ কারণে বর্তমান ভারতে পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। দামও কিছুটা চাপের মুখে রয়েছে। ভারতের এই চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়ীরা আরেক দফা দাম বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওই সময় তারা ভারতের প্রসঙ্গটি টেনে বলেছেন, এখন বাড়তি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। দুর্গোপূজার পাঠাবলি উৎসব ও সামনের কালীপূজাতে পাঠা খাওয়া হবে। এই রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তাই এ মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম কমার তেমন সুযোগ নেই। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তি। তবে দেশে পেঁয়াজের কোন ঘাটতি নেই। দেশীয় উৎপাদন ভাল হয়েছে। তাই এ বছর বাইরে থেকে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হবে। আমদানিকৃত এই ৫ লাখ টনের বেশিরভাগ পেঁয়াজ আবার এসে গেছে। তাহলে এখনও দাম কমছে না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারতে দাম কমছে না। এই কারণে রাখী পেঁয়াজের মজুদকারীরা বাজারে পেঁয়াজ ছাড়ছে না। তারা বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, এসব ব্যবসায়ীরা ‘ধরা’ খেতে পারেন। কারণ আগামী নবেম্বর শেষ নাগাদ নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হবে ভারতের নাসিকে। তখন আমদানি মূল্য কমিয়ে আনা হলে দেশে পেঁয়াজের বাজার পড়ে যাবে। তিনি বলেন, দ্রুত মজুদকৃত এসব পেঁয়াজ বাজারে আনলে ব্যবসায়ীরা ভাল দাম পাবেন। তা না হলে তারা বড় ধরনের ধরা খেতে পারেন। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমদানিকৃত ভারতীয় প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। এছাড়া দেশীটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকায়। ইতোমধ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সারা বছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। এ বছর এখন পর্যন্ত মজুদ রয়েছে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন। এছাড়া আরও ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। প্রতি মাসে চাহিদা রয়েছে ২ লাখ টনের। রমজান ও কোরবানি ঈদের সময় বাড়তি আরও ১ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ইতোপূর্বে ঢাকা আমদানিকারক সমিতির সদস্য ও শ্যাম বাজারের পেঁয়াজের আমদানিকারক হাজী মোঃ রফিক, হাজী হাফিজুর রহমান, হাজী মোঃ মাজেদ, আড়ত মালিক শামসুল আলম ও হাজী মোঃ মতিন গাজীকে ডেকে আনা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই সময় সচিবের নেতৃত্বে একটি সভা করা হয়। সেই সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারাও যোগ দেন। পর্যাপ্ত মজুদ ও আমদানি পরিস্থিতি ভাল থাকার পরও কেন দাম বাড়ছে সচিব জানতে চাইলে ওই সময় ব্যবসায়ীরা এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে ওই সভায় ব্যবসায়ীদের কড়া ভাষায় সতর্ক করে দেন বাণিজ্য সচিব। পেঁয়াজের মূল্য স্বাভাবিক না হলে তাদের আইনের আওতায় আনার কথাও জানিয়ে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা পেঁয়াজ আমদানিকারক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী মোঃ মাজেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পেঁয়াজের দামটাম নিয়ে জানতে ইতোমধ্যে সচিব আমাদের ডেকেছিলেন। মজুদ না করতে দেশের সব ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এটা নিয়ে তেমন কিছু করার নেই। ভারতে দাম বৃদ্ধি তাই আমাদের বাজারও চড়া।
×