ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে মৃত্যুদূত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২২ অক্টোবর ২০১৫

সড়কে মৃত্যুদূত

যে কোনদিন যে কোন সময় যে কেউ হয়ে যেতে পারেন রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন লাশ। রাস্তায় নামলেই মৃত্যুদূত এসে তাড়া করে পেছন পেছন। ঘাতকের বেশে যমদূত যানবাহন এসে পিষ্ট করে দিতে পারে যে কোন পথচারীকেও। এমনিতেই দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো দিন দিন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হচ্ছে। প্রাণহানি ও সম্পদহানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক কোন কারণ নয়। বরং মানবসৃষ্ট। বলা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয় তাদের পরোক্ষভাবে হত্যাই করা হয়। এ হত্যাকারীদের বিচার করার কেউ নেই। বিচারের আওতায় আনার মতো বিধিবিধানও অকার্যকর। একটা দুর্ঘটনা একটা পরিবারকে সারা জীবনের জন্য দুঃখের প্রদীপ ধরিয়ে দেয়। সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনের অপচয় যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এই মৃত্যু- তার জবাব মেলে না। কারণ হিসেবে অনেক কিছুই সামনে দাঁড়ায়; কিন্তু সে সবের প্রতিকার নেই। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক ব্যবস্থার বেহাল দশা, খানাখন্দেপূর্ণ সড়ক, ওভারটেক এবং পথচারীদের অজ্ঞতার কারণে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তুলেছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ৫৫ জনের মতো। বছরে এ সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। যার মধ্যে ৩২ শতাংশই হচ্ছে পথচারী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১২টি দেশের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে নিহতের হার সর্বোচ্চ এবং এ সংখ্যা ১৬৯ জন। সড়ক দুর্ঘটনা দেশের অর্থনীতির জন্যও ডেকে আনছে সর্বনাশ। এক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ১ দশমিক ৬ শতাংশের সমান। এমনিতেই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতি অপূরণীয়, বিশেষ করে দরিদ্র দেশের গরিব মানুষের জন্য। দেশের ৩৪৯২ কিলোমিটার রাজপথ এবং ৪২৬৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক পথ বর্তমানে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণে সড়কের অবকাঠামোগত কোন উন্নয়নই হচ্ছে না। স্বয়ং মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কথা। বছর বছর রাস্তা মেরামত ও সংস্কার করা হলেও সবই অপচয় খাতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে দুর্নীতির মহোৎসব চলে। কিন্তু এই দুর্নীতিবাজদের কারণে যথাযথ মেরামত ও সংরক্ষণ হয় না সড়ক। যানবাহন চালকদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। আইনকানুন সম্পর্কে সাধারণ ধারণাও নেই। অনেকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যানবাহন চালায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম থাকায় অদক্ষরাও যান চালানো তথা হত্যার অধিকার পেয়ে যায়। দেখা গেছে পথচারী হত্যার অভিযোগে চালককে গ্রেফতার করা হলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকে যান চলাচল বন্ধ রেখে দুর্ভোগ বাড়ায়। আর এই কারণে হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নও করা যাচ্ছে না। দেশে রাস্তার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যে হারে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে তা এক সময় মহামারীতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। কারণ দুর্ঘটনা প্রতিকার ও প্রতিরোধে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার কারণ জানা গেলেও তা সমাধানের উপায় উদ্ভাবন করা হচ্ছে না। এমনকি বিদ্যমান আইনেরও প্রয়োগ নেই। দুর্ঘটনায় পর তাই মামলাও হয় না। চালক ও পথচারীরাও ঠিকমতো আইন মানে না। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে রাস্তায় চলন্ত যানবাহন ও তার চালক হয়ে যেতে পারে মৃত্যুদূত। জনসচেতনতা তৈরি, চালক প্রশিক্ষণসহ বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান করা না গেলে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। দেশবাসী এসব হতে পরিত্রাণ চায়।
×