নাজনীন আখতার ॥ এক সময়ের পাকিস্তানের অভিজাত বাণিজ্য নগরী করাচী এখন অপরাধীদের ভূ-স্বর্গে পরিণত হয়েছে। যানজটের দুর্ভোগ ও বিদ্যুত বিভ্রাটের মতো অপরাধ সেখানে নাগরিক জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ভর করছে করাচীর ওপর, সেখানে গ্যাংস্টার, সন্ত্রাসী, পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলতে থাকা ক্ষমতার লড়াই এখন করাচীর ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের জিডিপির এক-চতুর্থাংশ করাচীর ওপর নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতিতে নগরীর এ দুরবস্থা পাকিস্তানের জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বুধবার দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে করাচীকে বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস নগরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদক সামিরা সকালে পুরনো কিছু ঘটনা ও এক সাংবাদিকের বয়ানে তুলে এনেছেন করাচীর চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০১৪ সালের ৮ জুন রাত এগারোটার ঘটনা। করাচীর জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের বাইরে ইউনিফর্মধারী ১০ জন ছড়িয়ে পড়ল। তাদের প্রত্যেকের হাতে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক অস্ত্র; গ্রেনেড ও রকেট লাঞ্চারও রয়েছে। তারা কমপ্লেক্সের ভেতর দুটি দলে ছড়িয়ে পড়ল। একটি দল সরকারী উর্ধতন কমকর্তা ও কূটনীতিকদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। বোঝাই যাচ্ছিল এটা পূর্বপরিকল্পিত। কারও কারও ইউনিফর্মের নিচে আত্মহত্যার সরঞ্জাম রাখা। পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদভিত্তিক চ্যানেল জিও টিভির ক্রাইম রিপোর্টার জিলে হায়দারের বাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। তিনি তার বাড়ি থেকেই তুমুল বিস্ফোরণের শব্দ পেলেন। পুলিশ সূত্র থেকেই হায়দার জানতে পেরেছিলেন এয়ারপোর্টে আক্রমণের আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। তাই বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া মাত্র হায়দার তার অফিসকে জানান এবং সেদিন তার ছুটি থাকলেও তিনি অফিসের পুরো টিম নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে যান।
ওই প্রতিবেদনের ঘটনায় ১২ বছরের সাংবাদিক জীবনে খ্যাতিতে পৌঁছে যান হায়দার। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এ সাংবাদিকতার কারণেই হায়দারের জীবন আজ ঝুঁকির মধ্যে। তিনি তালেবানের হিট লিস্টে এখন।
ওই দিন বিস্ফোরণের ঘটনার ২০ মিনিট পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান হায়দার। গিয়ে দেখতে পান ভেতরে ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা। এয়ারপোর্টের নিরাপত্তারক্ষীরা জঙ্গীদের দিকে গুলি ছুড়েছে। যাত্রীরা যে যেভাবে পেরেছেন লুকিয়ে পড়েছেন। আর রানওয়েতে প্লেনের ভেতর আটকে রয়েছেন শত শত যাত্রী। রাত একটার দিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে পুরো স্থান সিলগালা করে দেন। ওই সময় ভেতরে হায়দার আটকে যান। আর এয়ারপোর্ট কমপ্লেক্সের বাইরে আটকে পড়েন অন্য সাংবাদিকরা। হায়দারের দাবি অনুযায়ী তিনিই ছিলেন একমাত্র সাংবাদিক যিনি ভেতরে ছিলেন এবং তার মোবাইল ক্যামেরায় পুরো পরিস্থিতি ভিডিও করেন। মোবাইল থেকে তিনি তার সহকর্মীদের সময়ে সময়ে ঘটনার আপডেট জানিয়ে টেক্সট করেন।
ওই সময় টিভি চ্যানেলগুলো ঘটনার লাইভ সম্প্রচার করছিল। ঘরে বসেই দর্শকরা প্রতিমুহূর্ত আপডেট পাচ্ছিলেন। কিভাবে সেনাসদস্যরা প্রবেশ করছেন। পুলিশ কোথায় অবস্থান নিয়েছে। কোন কোন জায়গা কর্ডন করে রাখা হয়েছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে জঙ্গীরা টিভিতে সেসব দেখে তাদের অবস্থান ঠিক করে নিচ্ছিল। ওই ঘটনার জন্য হায়দার নিজেকে অনেকটা দায়ী করে বলেন, ‘আমি স্বীকার করছি এটা করা ঠিক নয়। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি কী করতে পারতাম? এটা তো আমার কাজ।’ তিন বছর আগে হায়দার তালেবানের দুই গ্রুপের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয় এবং তার বাহু থেকে তিনটি গুলি অপারেশন করে বের করা হয়। ওই ঘটনাটিকে জিও টিভি তাদের প্রচারেও কাজে লাগায়। তারা ক্যাপশন করতে থাকেÑ ‘যখন বুলেট, বিস্ফোরণ ঘটার স্থান থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়ায়, তখন জিও স্টাফ থাকে সাহসী ও ভীতিহীন। জীবন হাতে নিয়ে তারা তাদের দায়িত্বে অবিচল থাকে।’
ভোর হওয়ার এক ঘণ্টা আগে চারটার দিকে যুদ্ধ থামল। নিরাপত্তা বাহিনী ১০ জঙ্গীর মধ্যে ৮ জনকে মেরে ফেলেছিল। বাকি দুই জন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করে। এয়ারপোর্টের ৪ কর্মীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর ১৪ জন নিহত হয়েছিল। ঘটনার কয়েক দিন পর নিহতের সংখ্যা বেড়েছিল। এয়ারপোর্টের কোল্ডস্টোরেজে লুকিয়ে থাকা ৭ জন ঠা-ায় জমে মারা গিয়েছিল। পাকিস্তানে তালেবানের শাখা সুন্নী চরমপন্থী গ্রুপ টিটিপি ওই হামলার দায় স্বীকার করে।
গত ১৫ বছরে করাচীতে এ ধরনের জঙ্গী হামলা অন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। ২০১১ সালের মে মাসে একটি বাসে গানম্যান প্রবেশ করে ৪৬ ইসমাইলিয়া শিয়া হত্যা করে। এ ধরনের হামলাগুলো এত দ্রুত একের পর এক ঘটতে থাকে যে ছুটির দিনেও করাচীতে উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি করা হয়। অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর করাচী ছিল কসমোপলিটন বন্দর সিটি। যেখানে লোকসংখ্যা ছিল ৫ লাখ। জাতির জন্য নতুন আশা স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল করাচী। ৬০ বছর পর আজ সেই শহর বিশ্বের সবচেয়ে সহিংস শহরে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন ২ কোটি ৩০ লাখ লোকের বাস। অপরাধ সেখানের বাসিন্দাদের জীবনে যানজট ও বিদ্যুত বিভ্রাটের মতো একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালে করাচীতে ২ হাজার ৭শ’ লোক খুন হয়েছে, যা বিশ্বের যেকোন শহরের তুলনায় সর্বোচ্চ। ধনী লোকদের বাড়িতে অস্ত্রসজ্জিত গার্ড থাকে। কিছু অভিজাত এলাকায় বেকারির দোকানেও মেটাল ডিটেক্টর রাখা আছে। রাইফেল কাঁধে নিয়ে গার্ডরা পাহারা দেন। অপরাধের ঘটনা এতটাই বেশি যে, ইংরেজী ভাষার পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন তাদের করাচী সংস্করণে আলাদাভাবে ‘শূটিং এবং রেইড’ অথবা ‘দুর্ঘটনা এবং মৃতদেহ পাওয়া গেছে’ শিরোনামে আলাদা স্থানই বরাদ্দ করেছে।
তবে এ অতিমাত্রায় অপরাধই শুধু করাচীতে এভাবে আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়নি, সেখানে রাজনীতিতেও প্রত্যেক স্তরে অপরাধ সর্বোচ্চভাবে জড়িয়ে পড়েছে। পার্লামেন্টে যোগ দিচ্ছে গ্যাংস্টাররা। রাস্তায় হত্যায় মদদ দিচ্ছে রাজনীতিকরা। করাচীর অপরাধীচক্র নিজেদের শুধু বস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। সেখানে বিলিয়ন রুপীর চাঁদাবাজি চলে।
প্রতিবেদক একটি দরিদ্র গ্রাম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলেন, একজন স্থানীয় যুবক নেতা জানিয়েছেন, গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারগুলোর অন্তত তৃতীয় একটি আয়ের মাধ্যম হচ্ছে পানির ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে বিক্রি করা। পানির মাফিয়া চক্র পানির মূল সরবরাহ লাইন বন্ধ করে রাখে এবং ট্যাংক থেকে চুরি করা পানি আবার সাধারণের কাছে বিক্রি করে। পরিবহন মাফিয়ারা পরিবহন খাতের সুব্যবস্থাপনাকে কোণঠাসা করে রাখে। কিছু ক্ষেত্রে বেশিরভাগ নাগরিক অপরাধীদের সঙ্গেই ব্যবসা করে। একটি বাড়ি কিনতে, একটি ব্যবসা শুরু করতে, একটি বাস পেতে, পানি পেতে তাদের অপরাধীদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গী গ্রুপগুলো এ অবস্থারই সুযোগ লুফে নিচ্ছে। এখন সুইসাইডাল বম্ব এবং সহিংস হামলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে নিয়মিত বন্দুকযুদ্ধ। এটা ব্যবহার হচ্ছে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্য এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের হত্যার জন্য।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলী খান জানিয়েছেন, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসবাদÑ এই চারটি ঘৃণ্য অপরাধ দমনে পুলিশ ও প্যারামিলিটারি ফোর্স পাকিস্তান রেঞ্জার্স কাজ করছে। এ মিশনের নাম দেয়া হয়েছে করাচী অপারেশন। তবে এর আওতায় নাটকীয়ভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বাড়ছে। অপারেশন শুরু হওয়ার পর এনকাউন্টারের নামে পুলিশের হাতে ৮শ’ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সেটা আত্মরক্ষার্থে ঘটেছে।