ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের জন্মদিন আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাটি, মাটি ও মানুষের কথা বলা স্বদেশের ভাবনাতাড়িত এক কবি শামসুর রাহমান। কাব্য রচনায় ছন্দোময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে ধারণ করেছেন বাঙালীর ও বাংলা ভাষার অনন্য কবির পরিচয়। আপন কাব্যশৈলীর গুণে আবির্র্ভূত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কাব্যভুবনে সবচেয়ে আলোচিত কবির পরিচয়ে। সমকালীনতা ধারণকারী অনন্য প্রতিভায় উজ্জ্বল এই নাগরিক কবি ছিলেন বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। কবিতায় সৃষ্টি ও মননের জ্যোতির্ময় উপস্থাপনা তাঁকে দিয়েছে কবিতার বরপুত্রের উপাধি। আজ শুক্রবার কবির ৮৭তম জন্মদিন ও ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরনো ঢাকায় জন্মেছিলেন দেশবরেণ্য এই প্রয়াত কবি। শামসুর রাহমানের ৮৭তম জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে আজ বিকেল ৪টায় বাংলা একাডেমির রবীন্দ্রচত্ব¡রে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যৌথভাবে কবির জন্মদিন উদ্্যাপনের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও শামসুর রাহমান স্মৃতিপরিষদ। শামসুর রাহমান স্মৃতিপরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেবেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে আবৃত্তি, কবিকণ্ঠে নিবেদিত কবিতা, নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশিত হবে। কবিকণ্ঠে নিবেদিত কবিতা পাঠ করবেন রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুবী রহমান, মুহম্মদ নূরুল হুদা, নূহ-উল-আলম লেনিন, কাজী রোজী, শিহাব সরকার, নাসির আহমেদ, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্র গোপ, কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, মুনীর সিরাজ, হালিম আজাদ, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, আমীরুল ইসলাম, আসলাম সানী, তারিক সুজাত, অঞ্জনা সাহা, মৃত্তিকা গুণ ও দীপিতা রাহমান। শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে আবৃত্তি করবেন লায়লা আফরোজ, রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন নিপু, আহ্কাম উল্লাহ্্ ও নায়লা তারান্নুম কাকলি। সঙ্গীত পরিবেশন করবেন রফিকুল আলম, মহীউজ্জামান চৌধুরী, বুলবুল মহলানবীশ, মাহজাবিন রহমান শাওলী, উত্তম ঘোষ প্রমুখ। এম আর ওয়াসেকের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করবে নন্দন কলা কেন্দ্রের শিল্পীরা। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরনো ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নেননি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। শেষ হয় তাঁর ৭৭ বছরের জীবন পরিভ্রমণ। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী ৭৭ বছরের বর্ণময় জীবনের বড় অংশজুড়েই শামসুর রাহমান নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবিতার কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ভূমিকাটি একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। ষাটের দশকে গোড়ার দিকেই কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত করেন সাহিত্যের ভুবন। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতায় ধাবিত হলেও একটা সময়ে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন নিবিড় মমতায়। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত। ১৯৪৯ সালে শামসুর রাহমান লেখেন প্রথম কবিতা ‘১৯৪৯’। প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আর এই শুরুটা ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতার সৃষ্টিসম্ভার। পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই এপার-বাংলার কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলোÑ রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ ও আমি অনাহারী। অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও রাজনীতির দহন থেকে গা বাঁচিয়ে চলেননি এই কবি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। রচনা করেছেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। তাঁর রচিত বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থগুলোয় তীক্ষè ও প্রবলভাবে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। সত্তরের নবেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ অথবা তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, একাত্তরের পটভূমিতে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, গেরিলা, কাঁক ইত্যাদি কবিতাগুলোয় উচ্চারিত হয়েছে এদেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ ও ইকারুসের আকাশ। যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্য ভাষ্যকার। একই সঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বার বার বিতর্ক তুলেছে কূপম-ূক মৌলবাদীরা। এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য শ্যামলীর বাসায় হামলাও করেছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। এত কিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসে অনড় ছিলেন। কবিতার চরণে চরণে বলেছেন সম্প্রীতির কথা। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন শামসুর রাহমান। এর বাইরে গীতিকার হিসেবেও তাঁর আরেকটি পরিচয়। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্তমিলে ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি, স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে, ফসলের মাঠে/মেঘনার তীরে, অনেক দিনের মতো এই দিন, এই মাটির কণা, স্বাধীনতা তুমি আছ বলে গোলাপ চামেলি ফোটে, এল নববর্ষ/শুভ নববর্ষ, বৈশাখী দিনে, ধু ধু পিপাসার ক্ষণে, শূন্যে ডালে হঠাৎ হাওয়ায় লাগল ঝাঁকি, বৈশাখেরই অগ্নিঝালর দহন আনে জুড়ে, কথার ছলেই কথা দিয়েছিলে, মধুময় পৃথিবীকে নীলাকাশ ডাকবে, তোমার হৃদয়ে শ্রাবণের বর্ষণ, মেঘের কিনারে রঙধনু জাগে ইত্যাদি। শামসুর রাহমান রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬টি। উপন্যাস লিখেছেন চারটি। একটি করে রয়েছে প্রবন্ধ ও ছড়ার বই। অনুবাদ বইয়ের সংখ্যা ৬টি। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে মর্নিং নিউজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ ঘটে তাঁর। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এর মাঝে আবার ফিরে আসেন পুরনো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে নবেম্বর থেকে শুরু করে দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অধুনার সম্পাদকের দায়িত্ব¡ পালন করেন। কাব্য রচনায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেয়া হয়।
×