ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাহবুব রেজা

সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে॥ বীরাঙ্গনারা পেল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে॥ বীরাঙ্গনারা পেল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ নারী সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে সবসময়ই পুরুষের পাশে থেকে তাকে প্রেরণা দিয়েছে। দিয়েছে শক্তি সাহস। পুরুষের বিজয়ের নেপথ্যে থাকে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত তাই আমরা পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও দেখি সমান্তরালভাবে। নারী-পুরুষ যৌথভাবে পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছেন সামনের দিকে। উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, যুদ্ধ-শান্তি, উত্থাপন-পতন সবকিছুতে নারী পুরুষের সমান অবদান রেখে এসেছে। আদিযুগে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা আমাদের সেসব কথাই মনে করিয়ে দেয়। হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে নারী-পুরুষের সম্মিলিত বিজয়গাঁথা। তারই পরম্পরায় দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, পরিশেষে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধÑ সবকিছুর মধ্যে দেশের নারী সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আন্দোলন-সংগ্রামকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মিলিত নারী সমাজের সাহসী ভূমিকা যুদ্ধে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও জীবনদান এই যুদ্ধকে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। যুদ্ধ শেষে লাল-সবুজের পতাকা যখন বাংলার আকাশে-বাতাসে পত পত করে উড়েছে তখন তার মধ্যে বাংলার লাখ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগ বড় হয়ে দেখা দেয়। দেশমাতৃকার টানে বাংলার নারী সমাজ তাদের সর্বস্ব উজাড় করে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধে নারীদের বীরত্বগাঁথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাদের এই আত্মত্যাগ বাংলার নদী, বাংলার জল, বাংলার প্রকৃতি সারাজীবন মনে রাখবে। যুদ্ধে জীবনদানকারী, অংশগ্রহণকারী নারী সমাজের প্রকৃত মূল্যায়ন কী হয়েছে? এ রকম বিতর্ক রয়েই গেছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক উদাত্ত কণ্ঠে বীরাঙ্গনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিত নারীদের দিয়েছিলেন পিতৃ-পরিচয়। তিনি তাদের জন্য সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের বেদনাবিধুর হত্যাকা-ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারী ও বীরাঙ্গনাদের সে বিষয়টি ঝুলে যায় নানা সিদ্ধান্তহীনতায়। যুদ্ধে নির্যাতিত অসহায় নারীরা তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পাননি। অবশ্য এ নিয়ে তাদের কোন অভিযোগও ছিল না। যুদ্ধে অংশ নেয়া সাহসী নারীরা সবসময়ই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, কোন স্বীকৃতি বা সম্মাননা পাওয়ার জন্য তারা যুদ্ধ করেননি। তারা যুদ্ধ করেছেন দেশ মাতৃকার টানে, অস্তিত্বের দায়ভার থেকে। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চরম শিকার হয়েছেন যুদ্ধে অংশ নেয়া নারীরা- এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও চিন্তাবিদরা। অবশেষে ৪৪ বছর অপেক্ষার পর যুদ্ধে অংশ নেয়া অত্যাচারিত বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে এ স্বীকৃতির মাধ্যমে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও নির্যাতিত নারীদের দেশব্যাপী তালিকা প্রণয়ন এবং তা থেকে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে মোট ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এরপর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এ স্বীকৃতি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্স ফাই-িং কমিটির (ডঈঋঋঈ ) কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক এটিএম রবিউল করিম বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে জানান, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে বীরাঙ্গনারা যেমন সম্মানিত হয়েছে, রাষ্ট্রও তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, বিলম্বে হলেও এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভমহানির মর্যাদা দিয়েছে সরকার। এই স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে তারা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। তবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই ৪১ জনের বাইরেও অসংখ্য নির্যাতিত বীরাঙ্গনা রয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্বাধীনতার এত বছর পরও বীরাঙ্গনাদের অনেকে সামাজিক কারণে মুখ খুলছেন না। অভাব অনটন, অবহেলা, বঞ্চনাকে নিত্যসঙ্গী করে এতটা বছর তারা যুদ্ধদিনের নির্যাতন বীরত্বকে বহন করে চলছিলেন। অভাবের তাড়নায় বীরাঙ্গনাদের অনেককেই মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়েছিল। এতদিন যাবত সরকার, প্রশাসন তাদের কোন খোঁজ-খবর রাখেনিÑরাখার প্রয়োজনও মনে করেনি। তবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের আগে-পরে গণমাধ্যম কর্মীরা তাদের খোঁজ-খবর নিত, সংবাদ পরিবেশন করত। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বীরাঙ্গনারা এখন থেকে সরকার প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা পাবেন। বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার এই স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সাহসী নারীরা প্রেরণা পাবেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়বে দশ দিগন্তে। উত্তর প্রজন্ম এই সব অকুতোভয়, লড়াকু নারীর যুদ্ধদিনের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব মাখা ভূমিকায় নিজেদের সমৃদ্ধ করবে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন করে বলেছিলেন, ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে...। athairdha [email protected]
×