ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিজেন শর্মা

মানা ও মুন্নির বাগান

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

মানা ও মুন্নির বাগান

মুন্নি লন্ডনে বাড়ি কিনে জানাল আমার এখনই আসা দরকার, কেননা বাড়ির পেছনের জায়গাটায় বড় একটা জঙ্গল জেঁকে বসেছে, ওটাকে বাগান বানিয়ে দিতে হবে। অতএব যেতে হলো। ওক উড আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের কাছেই সেই বাড়ি। সামনে ও পেছনে বড় বড় গাছ, যেন অরণ্যের অন্দরমহল, ভারি নির্জন। বাড়ির সামনে খানিকটা খালি জায়গা, একপাশে কাঁধসমান উঁচু হ্যাজ, যত্রতত্র কয়েক ঝাড় বুড়ো গোলাপ, তাতে অজস্র কাঁটা, যেন দাঁত খিঁচিয়ে আছে। বাড়ির পেছনের জায়গাটা বেশ বড়, এককালে বাগান ছিল, গোলাপ লাইলাক হানিস্যাকল ও ক্লিমেটিস দেখে সেটা বোঝা যায়। কিন্তু এগুলো অন্যান্য অচেনা ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিলেমিশে যে জঙ্গল বানিয়েছে, তা থেকে মূল বাগানটি উদ্ধার প্রথম দৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলো। ব্ল্যাকবেরি, ভিজিনিয়া ও আইভি লতায় জায়গাটা ঠাসা ও ঘুটঘুটে। মনে পড়ল ম্যানচেস্টারে মানার বাড়ির কথা। ১৯৭৭ সালে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়ে ওখানেই উঠেছিলাম। মুন্নির বাড়ির মতোই সামনে পেছনে কিছুটা করে খালি জায়গা, কিন্তু কোনো গাছগাছড়া নেই, পুরোটাই বাঁধানো। একদিন খেয়াল হলো ইট-সুড়কি ভেঙে ফেলে ওখানে বাগান করব। লেগে গেলাম কোদাল, খুন্তি-শাবল নিয়ে। আদ্যিকালের মাটি বেরিয়ে পড়ে কতদিন পর আলো দেখল জানি না। গেলাম গার্ডেন সেন্টারে। কিনে আনলাম লতানো গোলাপ, রডোডেনড্রন, ক্যামেলিয়া, ক্লিমেটিস ও একঝাড় কাশজাতীয় ঘাস এবং লন তৈরির জন্য কয়েক খ- দূর্বার চাপড়া। আর কী কী এনেছিলাম মনে নেই। ব্যস, একদিনেই বাগান। প্রতিবেশীরা বাগান দেখে ভারি খুশি। পরে মানার লাগানো আপেল, নাসপতি ও প্লাম গাছে ফল ধরে, গেলে সেসব খাওয়া হয়, না গেলে ফ্রিজে রেখে সে আমার জন্য অপেক্ষা করে। পঁয়ত্রিশ বছর পর আরেকটি বাগান সংস্কারে লাগতে হলো। মুন্নির বাগান। কাজটা কঠিন, গাছ কাটা আমার অপছন্দ, তবু কাটতে হলোÑ ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন। ধীরে ধীরে বাগানের পুরান আদলটি স্পষ্ট হতে লাগল। বুঝলাম ওস্তাদের নির্মাণ, যিনি ফুলের চেয়ে পাতার গড়ন ও রঙের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন অধিক আর লাল ছিল তাঁর প্রিয় রঙ। মাঝখানে বাঁকানো একটা লন রেখে চারপাশে লাগিয়েছিলেন নানা উচ্চতার গুল্ম ও লতা, কিছু রঙিন ঘাসের ঝোপ। মাটি খুঁড়তে গিয়ে পেলাম অনেক গাছের ছবিসহ নামলিপি, যাদের অনেকগুলোরই আর হদিস নেই। এভাবেই জানা গেল বাগানের এক কোণে তারই বানানো একটি নির্জন জায়গাÑ নিভৃত নিকুঞ্জ যার ফটকে লাগানো লতা-গোলাপের নামÑ কমপ্যাসন, পেলাম ঝুমকো ও ডেলফিনিয়ামের খোঁজ, বেঁচে আছে কি-না জানা যাবে আগামী বসন্তে যখন আর আমি এখানে থাকব না। এভাবেই কাজটি শেষ হলো। সময় পেলেই বাগানে ঘুরে বেড়াই। এতবড় অস্ত্রোপচারের পর বাগানটি ধ্বস্ত। তবে ধীরে ধীরে সে আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, নতুন ডালপালা ছাড়বে গাছগাছালি; হারানো লাবণ্য ফিরে আসবে। ভাবি যার নির্মাণটি পুনর্স্থাপন করলাম, তাকে আমি চিনি না, চিনবও না কোনোদিন, তবু দেশে ফিরে বাগানটির কথা যেমন মনে পড়বে, তেমনি তার কথাও। কী অদ্ভুত সখ্য এই বাগানের সঙ্গে, বাগানীর সঙ্গে।
×