ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

দুর্বল হচ্ছে সমুদ্র স্রোত উঁকি দিচ্ছে বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৩ অক্টোবর ২০১৫

দুর্বল হচ্ছে সমুদ্র স্রোত  উঁকি দিচ্ছে বিপর্যয়

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের এক জায়গার পানি বেশ ঠা-া। গত আট মাসে সেখানকার পানি ছিল রেকর্ড মাত্রায় ঠা-া। বিশ্বব্যাপী সেখানে রেকর্ড উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছে, তাহলে ওখানকার পানি এত ঠা-া থাকছে কেন? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের যে পরিণতি সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেটাই এখন সত্য হতে চলছে। কি সেই পরিণতি? সেটা হলো সাগরের এ অংশের উপরিভাগের পানি স্বাদু তথা মিঠে পানিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো কেমন করেই বা উত্তর আটলান্টিকের ঐ অংশের জলরাশি স্বাদু তথা মিঠে পানিতে পরিণত হলো? এর উত্তর হলো, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ দ্রুত গলছে। বরফ গলা এই স্বাদু পানি বিপুল পরিমাণে চলে আসছে উত্তর আটলান্টিকের অংশে। আর তার ফলেই ওখানকার সমুদ্রস্রোত মন্থর বা দুর্বল হয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে স্বাদু পানির সঙ্গে সমুদ্রস্রোত দুর্বল হওয়ার কি সম্পর্ক? সম্পর্কটা এই যে, স্বাদু পানির প্রবাহের কারণে সাগরপৃষ্ঠের শীতল জলরাশির ঘনত্ব কমে যায়। বলাবাহুল্য, শীতল লবণাক্ত জলরাশির ঘনত্ব বেশি থাকে। এখন স্বাদু পানির প্রবাহ যদি সাগরপৃষ্ঠের শীতল জলরাশির ঘনত্বকে কমিয়ে দেয়, তাহলে সেই কম ঘনত্বের শীতল লোনা জলরাশি উত্তর আটলান্টিকের নিচ দিকে থেমে যায় না এবং গভীর নিচ দিয়ে দক্ষিণমুখে এন্টার্কটিকার দিকে ফিরে যায় না। এই না যাওয়ার ফলে সেই শূন্যস্থানও সৃষ্টি হয় না যা পূরণের জন্য সাগরপৃষ্ঠের উষ্ণ জলরাশি উত্তর দিকে প্রবাহিত হয় না। এ কারণে সমুদ্রবাহিত তাপ উত্তরের দিকে কম পরিমাণে পৌঁছানোর ফলে উত্তর গোলার্ধের জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে পারে। নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্রে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেটা তা তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এমন ঘটনা পৃথিবীর দূর অতীতেও ঘটেছে। এবং একবার নয় বহুবার ঘটেছে। এই ঘটনার জন্য হিমবাহের যুগ এসেছে। অবশ্য হিমবাহের যুগগুলোতে দীর্ঘ সময় একটানা হিম অবস্থা বিরাজ করেছে এমন নয়। এই দীর্ঘ অধ্যায়ের মধ্যে মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত দ্রুত ঘটে যাওয়া উষ্ণতর অধ্যায়ও থেকেছে। প্রশ্ন হলো হিমবাহের তাপমাত্রার এই উঠানামার কারণ কি? এর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হলো সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন। উত্তরের বিপুল পরিমাণ বরফ উত্তর আটলান্টিকে এসে পৃষ্ঠদেশের জলরাশিকে বিশুদ্ধ বা স্বাদু করে তোলে। এতে করে আটলান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত দুর্বল হয়ে যায়। উত্তর দিকে কম তাপ পরিবাহিত হয়, এতে শেষ পর্যন্ত হিমঅধ্যায় সৃষ্টি হয়। এই হিমঅধ্যায় দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়। তারপর আবার সমুদ্র স্রোতের গতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে সেটা কি কারণে হয় বিজ্ঞানীরা আজও তার সঠিক ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেননি। তবে গত ১ লাখ ১৫ হাজার বছরে উত্তর আটলান্টিকে জলবায়ুর শীতল থেকে উষ্ণ অবস্থায় হঠাৎ করে রূপান্তরের ঘটনা প্রায় ২৫ বার ঘটেছে। আর বিগত অন্তত ৭০ হাজার বছরে জলবায়ুর এই পরিবর্তন আটলান্টিক মহাসাগরের গভীর সমুদ্র স্রোতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে কোন না কোনভাবে যুক্ত বিশেষত উত্তর থেকে দক্ষিণ আটলান্টিকে প্রবাহিত গভীর সমুদ্র স্রোতের সঙ্গে। দ্বিতীয় গবেষণায় ১২ হাজার ৯শ’ বছর আগে হঠাৎ করে শুরু হওয়া একটা হিম অধ্যায়ের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। পৃথিবীটা সে সময় হিম যুগ থেকে বেরিয়ে বর্তমান আন্ত-হিম যুগে প্রবেশ করছিল। হঠাৎ করে তাপমাত্রা বদলে গিয়ে আবার শীতল হয়ে ওঠে এবং এই হিম অবস্থা এক হাজার বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। ফলে নতুন করে হিমবাহ ও বরফের আস্তরণ গড়ে ওঠে। এই আকস্মিক ও নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ হিসেবে আটলান্টিকের সমুদ্র স্রোতের পরিবর্তনকে দীর্ঘদিন ধরে দায়ী করে আসছিল। বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করছেন যে সেই ধরনের অধ্যায় অর্থাৎ হিমযুগের পর আবারও একটি আন্তঃহিমযুগ যেখানে তাপমাত্রা শীতল হলেও হিমযুগের মতো অত প্রচ- ঠা-া নয়, হয়ত আবারও ফিরে আসতে পারে এবং এ ক্ষেত্রেও আটলান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যদিও এটাই আন্তঃহিমযুগ ফিরিয়ে আনার একমাত্র কারণ নয়। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা ভাল। তাহলো আগের হিমযুগ বা আন্তঃহিমযুগ সৃষ্টির পেছনে সুমেরু অঞ্চলের বিশাল স্বাদু পানির হ্রদ লেক আগাসিজের বিপুল পরিমাণ পানির প্রবাহ দায়ী ছিল। তার সঙ্গে দায়ী ছিল লরেনটাইড আইস শীট যা গত হিমযুগে গোটা উত্তর আমেরিকাকে চেপে রেখেছিল। হ্রদের এবং বরফের আস্তরণের গলা পানির বিপুল প্রবাহই স্রোত মন্থর করে দিয়েছিল। এখন সেই হ্রদও নেই, লরেনটাইড আইসশীটও নেই। এখন গলছে গ্রীনল্যান্ডের বরফ। এই বরফ গলা স্বাদু পানি উত্তর আটলান্টিকে গ্রীনল্যান্ডের বেশ দক্ষিণে জমা হয়েছে। এ জন্য গত আট মাসে কানাডার পরিবেশ বেশ ঠা-া। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে অনুভূত হচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি।
×