ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কথা কবিতা গানে জন্মদিনে শামসুর রাহমান স্মরণ

তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা...

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৫

তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা...

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হেমন্তের বিকেলে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে উচ্চারিত হলো ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ শিরোনামের কবিতার চরণ। শিল্পিত শব্দগাঁথা কবিতার অনুরণন থামতেই ভেসে বেড়ালো গানের সুর। তুমি প্রিয় কবিতার ছোট্ট উপমা-এই বাণীর আশ্রয়ে রচিত গানের তালে নেচে উঠলো একঝাঁক কিশোরী। এভাবেই কবিতার ছন্দে, গানের সুরে ও নৃত্যের সংযোগে স্মরণ করা হলো স্বদেশের ভাবনাতাড়িত কবি শামসুর রাহমানকে। শুক্রবার ছিল বাঙালীর ও বাংলাভাষার অনন্য এই কবির ৮৭তম জন্মদিন। আর জন্মদিনে কবিকে নিবেদন করে আলোচনা করলেন বিশিষ্টজনরা, নিবেদিত কবিতাপাঠ করলেন কবিবৃন্দ, আবৃত্তিশিল্পীদের কণ্ঠে উচ্চারিত শামসুর রাহমানের কবিতা এবং শিল্পীরা গাইলেন গান। এভাবেই রঙে রঙে বর্ণিল হয়ে ওঠে কবির জন্মদিন উদ্্যাপনের আয়োজনটি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদ। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো হয় জন্মদিন উদ্যাপনের এ আয়োজন। শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন কবি তারিক সুজাত। বাংলা কাব্য ভুবনে শামসুর রাহমানের অবিস্মরণীয় অবদানসহ তাঁর বর্ণময় কবি জীবনের কথা উঠে আসে বক্তাদের আলোচনায়। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রায় ছয় দশক ধরে সাহিত্য-সাধনা করেছেন শামসুর রাহমান। অনেকেই তাঁর মতো দীর্ঘ সময় সাহিত্যচর্চা করেছেন। তবে জীবদ্দশায়ই তিনি শুধু কবি নন পরিণত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানে। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, সমাজ থেকে রাষ্ট্রÑ সব কিছুর ছোঁয়া পেয়েছে। শামসুর রাহমান কবিতা লেখার শুরুর ১০ বছর পর প্রকাশ করেছিলেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ। সামান্যতম দুর্বলতা আছে এমন কোন কবিতা তিনি কখনও কাব্যগ্রন্থে সংকলিত করতে চাননি। কবিতা সম্পর্কে এই সংযম ও সচেতনতার মধ্যেই কবি হিসেবে তঁাঁর অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কাব্য রচনায় গ্রিক পুরাণের যে আশ্রয় নিয়েছেন সেটাও অতুলনীয়। পুরাণের ঘটনাবলীর সঙ্গে সমকালীনতার সংযোগ ঘটিয়েছেন চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবিতায় সৃষ্টি করেছেন অবিস্মরণীয় ভাষা ও অলঙ্কার। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের পরে সহজাতভাবেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর নামটি চলে আসে। তাঁর কবিতায় ঘটেছে অনেক পালাবদল। ষাটের দশকে তুলে ধরেছেন রাজনৈতিক পটভূমি। তবে যেসব রাজনৈতিক কবিতায় লিখেছেন সেগুলো কখনও উচ্চকণ্ঠে পরিণত হয়নি। রাজনীতির পাশাপাশি প্রেম ও প্রকৃতিকে বিষয় করেও লিখেছেন কবিতা। তাই কবিতা ভালবাসলে তাঁর কবিতা পড়তেই হবে। এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণেই কবি হিসেবে শামসুর রাহমান প্রতিদিনই স্মরণীয়। শামসুর রাহমানের সঙ্গে আপন সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করেন সৈয়দ শামসুল হক। বলেন, শামসুর রাহমান যখন তরুণ ছিলেন তখনও তাঁর জন্মদিনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আজও মনে পড়ে মায়ের কোলে বসে জন্মদিনের খাবার খাচ্ছেন তিনি। সৈয়দ হক আরও বলেন, শামসুর রাহমান হচ্ছেন স্বাধীনতার কবিতা। এ স্বাধীনতা হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা ও রাজনীতির স্বাধীনতা। তাঁর কথা বলতে গেলে ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয় নিজের দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অচল হয়ে গেছে। তাঁর রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে অনেক আলোচনা ও প্রশংসা হলেও যেসব কবিতায় তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল পঙ্ক্তি সৃষ্টি করেছেন সেগুলো নিয়ে খুব একটা কথা হয় না। জীবদ্দশার শেষ দিকে চিৎকারসর্বস্ব কবিতা নিয়ে খুব বিমর্ষ থাকতেন শামসুর রাহমান। চারপাশে আজ অনেক কবি থাকলেও ঋষিতুল্য সেই কবি আর নেই। আলোচনায় এই সব্যসাচী লেখক জানান, আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শামসুর রাহমানকে নিবেদিত তাঁর লেখা নিয়ে প্রকাশিত হবে ‘মহান সতীর্থ শামসুর রাহমান’ শীর্ষক গ্রন্থ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, শামসুর রাহমান কখনও উচ্চকণ্ঠের কবি হতে চাননি। হতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের কবি। আর তাঁর প্রথম কবিতার পাঠক ছিলাম আমরা বন্ধুরা। তিনি বাংলাদেশে বা বাঙালী কবিÑ এটা আলোচ্য বিষয় নয়। তিনি হচ্ছেন আমাদের কবি। এ কারণেই সারাদেশ তাঁকে বুকের ভেতরে লালন করেছে। শামসুর রাহমান না থাকলে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ এতো সমৃদ্ধ হতো না। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে আবৃত্তি, কবিকণ্ঠে নিবেদিত কবিতাপাঠ ও সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এ পর্বের শুরুতেই সৈয়দ শামসুল হক আবৃত্তি করেন শামসুর রাহমানের কবিতা ‘দেবতারা’। এরপর পর শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী আহ্্কাম উল্লাহ্। কবি রুবী রহমান পড়ে শোনান শামসুর রাহমানে ৫০তম জন্মদিনে লেখা স্বরচিতা কবিতা। এছাড়া কবিকণ্ঠে নিবেদিত কবিতাপাঠ করেন রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, নূহ-উল-আলম লেনিন, কাজী রোজী, শিহাব সরকার, কাজল বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্র গোপ, কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, মুনীর সিরাজ, হালিম আজাদ, শাহজাদী আঞ্জুমান আরা, আমীরুল ইসলাম, তারিক সুজাত, অঞ্জনা সাহা, মৃত্তিকা গুণ, দীপিতা রাহমান প্রমুখ। শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ, রফিকুল ইসলাম, ও নায়লা তারান্নুম কাকলি। হেমন্তের সন্ধ্যায় সুরের মায়াজাল বুনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন রফিকুল আলম, মহীউজ্জামান চৌধুরী ময়না, বুলবুল মহলানবীশ, মাহজাবিন রহমান শাওলী ও উত্তম ঘোষ।
×