ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাফসান জানি

বন্ড সিরিজের কাল্পনিক প্রযুক্তি এখন সত্যি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৪ অক্টোবর ২০১৫

বন্ড সিরিজের কাল্পনিক  প্রযুক্তি এখন সত্যি

চলচ্চিত্রে অসাধারণ চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে নাম জেমস বন্ড। লন্ডনের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস প্রধান গুপ্তচর হিসেবে দেখা যায় তাকে। বিভিন্ন এ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করার সময় অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্ড। মুভিতে ব্যবহৃত এসব প্রযুক্তির অধিকাংশই তৎকালীন সময় ছিল কাল্পনিক। কিন্তু এসব প্রযুক্তি আর কাল্পনিক থাকেনি। বন্ড সিরিজের মুভিগুলোতে ব্যবহৃত কাল্পনিক প্রযুক্তির সফল রূপ দিয়েছেন প্রযুক্তি নির্মাতারা। সিরিজে ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলোর আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নির্মাতা তৈরি করেছেন অত্যাধুনিক সব গ্যাজেট। যা আগেই দর্শকরা জেমস বন্ডকে ব্যবহার করতে দেখেছে। কিছুদিন পরেই মুক্তি পেতে যাচ্ছে জেমস বন্ড সিরিজের নতুন মুভি ‘স্পেকচার’। দেখে নেয়া যাক বন্ড সিরিজে ব্যবহৃত গেজেট যা পরবর্তীতে তৈরি করে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছেন বর্তমান নির্মাতারা। জেটপ্যাক ॥ ১৯৬৫ সালে থান্ডারবেল মুভিতে গোপন এজেন্ডকে হত্যার পর দু’জন বন্দুকধারীর থেকে পালিয়ে যেতে জেটপ্যাক ব্যবহার করেন জেমস বন্ড। থান্ডারবেল মুভি নির্মাণে ৪৩ বছর পর ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের মার্টিন বিমান কোম্পানি তৈরি করে মার্টিন জেটপ্যাক। যাতে একটি গ্যাসোলিন ইঞ্জিনের সঙ্গে ওপরে উঠার জন্য দুটি পাখা লাগানো হয়। জেটপ্যাকটি প্রতি সেকেন্ডে ৬০ মাইল গতিতে ৫ হাজার ফিট ওপরে উঠতে সক্ষম ছিল। এছাড়া ফুয়েল ভর্তি এক ট্যাঙ্কে টানা আধা ঘণ্টা আকাশে ভাসতে পারত বলে জানিয়েছিল মার্টিন কোম্পানি। ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা ॥ থান্ডারবেল মুভিতে প্রযুক্তিবিদ খ্যাত কোয়ার্টারমাস্টার (কিউ) বন্ডকে একটি পানিরোধক ক্যামেরা দিয়েছিলেন যা দিয়ে অন্ধকারেও ছবি তোলা যেত। বন্ড এই ক্যামেরা দিয়ে এমিলিও লার্জোর গোপন কক্ষের ছবি তুলেছিল। আর এখন হাতের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে পানিরোধক ক্যামেরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অলিম্পাস স্টাইলাস টিজি-৩ যা দিয়ে ১৫ মিটার গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। ফোন নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ॥ ১৯৯৭ সালে ‘টুমুরো নেভার ডাইস’ মুভিতে বন্ড পেছনের সিটে বসে এরিকসন মোবাইল দিয়ে তার বিএমডব্লিউ গাড়ি চালাতে দেখা যায়। এই ডিভাইসটি ব্যবহার বন্ড কৌশলে তার শত্রুদের এড়িয়ে গেছে সহজে। বর্তমান সময়ে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারকে ড্রাইভার যাতে দূর থেকে স্মার্টফোন এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে সহজে চালাতে পারে সেইভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে। যেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য অল্প জায়গা রয়েছে, দরজা খোলা যায় না সেক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনায়াসে গাড়ি পার্ক করা যেতে পারে। এছাড়া খারাপ রাস্তায় রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম ব্যবহার করে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হওয়া যেতে পারে। রোবট কুকুর ॥ ১৯৮৫ সালে ‘এ ভিউ টু এ কিল’ মুভিতে দেখানো হয়েছে ‘কিউ’ ‘স্নোপার’ নামক একটি রিমোট কন্ট্রোল রোবট কুকুরের সঙ্গে খেলছে। কুকুরের চোখে লাগানো ভিডিও ক্যামেরা। মুভিটি রিলিজ হওয়ার পর বন্ড সিরিজে ব্যবহৃত কিউয়ের আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে সত্যিকারের রোবট কুকুর। আর এর সবচেয়ে সফল উদাহরণ হচ্ছে সনির ‘আইবো’। যা তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভাব প্রকাশ ও বাড়িতে ব্যবহৃত অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। সনি ২০০৬ সালে আইবো উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তবে বাজারে এ ধরনের বহুপণ্য পাওয়া যায়। যেমন জুমার ও টেক্টটা। কৃত্রিম ফিঙ্গার প্রিন্ট ॥ ১৯৭১ সালের মুভি ‘ডাইমন্ডস আর ফরেভার’। এতে ভিলিয়েন পিটার ফ্রাঙ্কসের আঙ্গুলের কৃত্রিম ছাপ বন্ড তার নিজের আঙ্গুলে লাগিয়ে ‘টিফানি কেইজে’ প্রবেশ করে। প্রায় ৪৩ বছর পর ২০১৪ সালে মোবাইল সিকিউরিটি ফার্ম লুকআউটের প্রিন্সিপাল রিসার্চার মার্ক রজার বন্ডের দেখানো পদ্ধতি ব্যবহার করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ আইফোনের টাচ আইডি সেন্সরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। কৃত্রিম ফিঙ্গার প্রিন্ট তৈরি করতে প্রথমে কৌশলে ব্যবহারকারীর আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নেয়া হয়। তারপর এই ছাপ ব্যবহার করে একটি সার্কিট বোর্ড কিট তৈরি করে যা দিয়ে অনায়াসেই নির্দিষ্ট ফোন আনলক করা যায়। পার্সোনালাইজড পিস্তল ॥ ২০১২ সালের মুভি ‘স্কাইফল’এ জেমস বন্ডকে তার হাতের তালুর সঙ্গে কোড করা একটি পিস্তল ব্যবহার করতে দেখা যায়। যা দিয়ে শুধুমাত্র বন্ডগুলো চালাতে পারে অন্য কেউ নয়। বর্তমানে আর্মেটিক্স নামক একটি জার্মান কোম্পানি এমনই একটি পিস্তলের ডিজাইন তৈরি করেছে। পিস্তলটি চালানোর সময় ব্যবহারকারীকে একটি দূর নিয়ন্ত্রিত হাত ঘড়ি পড়তে হবে। যা মাইক্রোক্লিপস ব্যবহার করে পিন কোডের মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। কখনও যদি বন্দুকটি ঘড়ি থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে বন্দুকটি আপনা আপনি ডিএ্যাকটিভেইট হয়ে যাবে যাতে অন্য কেউ গুলি ছুড়তে না পারে। রি-ব্রিথার ॥ থান্ডারবেল মুভিতে পানির নিচে লার্জোর আস্তানায় অনুপ্রবেশ করতে রি-ব্রিথার ব্যবহার করা হয়েছিল। পুলজুড়ে ছেড়ে রাখা হাঙ্গরদের পাশ কাটিয়ে লার্জোর আস্তানায় যেতে হয়েছিল বন্ডকে। আর এরই আপডেট ভার্সনটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘ডাই এনাদার ডে’ মুভিতে। বন্ডের রি-ব্রিথার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবরূপ দিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ান ডিজাইনার জেবেয়ান ইয়ন। যা ব্যবহারকারীকে মুহূর্তের মধ্যেই মানুষরূপী মাছে পরিণত করবে। কোন ধরনের অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার বহন না করে পানির নিচে থাকা যায় দীর্ঘসময়। ক্যামেরা রিং ॥ ১৯৮৫ সালের ‘এ ভিউ টু এ কিল’ মুভিতে বন্ড ক্যামেরা রিং ব্যবহার করে ম্যাক্স জরিনের প্রাসাদে পার্টিতে আসা অতিথিদের গোপনে ছবি তুলেছিল। জেমস বন্ড সিরিজের এই রিং ক্যামেরার আইডিয়াটি পরবর্তীতে কিনে নেয় হেয়নসিক স্টুডিও ও জেন ইয়েনগন। বন্ডের এই আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে রিংয়ে বসানো হয় ক্যামেরা যা একটি মোবাইল বা ট্যাবলেটের সঙ্গে যুক্ত থেকে ছবি তুলতে পারে। টেসার মোবাইল ॥ ‘টুমুরো নেভার ডাই’ মুভিতে বন্ড কার্বারের বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি কার্ড এরিয়াকে নষ্ট করে ফেলতে স্টানগান লাগানো একটি এরিকসন মোবাইল ব্যবহার করে। বন্ড পরবর্তীতে বুদ্ধি খাটিয়ে ড. কৌফম্যানকে তার টেসার লাগানো মোবাইলের বাটরে চাপ দিতে বাধ্য করে। বাটনে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর নিজে নিজে বিদ্যুতায়িত হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। সম্প্রতি মোবাইলে স্টানগান প্রযুক্তিটি কেউ ব্যবহার করার আগেই ইয়েলো জেকেট ৬৫০ শ’ ভোল্টের বিদু্যুত ব্যবহার করে একটি আইফোনের কেইস তৈরি করে। যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে নিমিষেই স্তব্ধ করে ফেলতে পারে। মাল্টি-টাচ টেবিল ॥ জেমস বন্ড সিরিজের ‘কোয়ান্টাম অফ সোলাক’ মুভিতে ক্রিমিনাল ডমিনিক গ্রিন সম্পর্কে তথ্য নিতে এমআই৬ এর সদস্যদের মাল্টি-টাচ টেবিল ব্যবহার করতে দেখা যায়। ২০০৮ সালে মাইক্রোসফট ও স্যামসাং ‘মাইক্রোসফট পিক্সেলসেন্স’ নামে একটি মাল্টি-টাচ কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। যা কোন ক্যামেরা ছাড়া স্ক্রিনের উপর রাখা একাধিক আঙ্গুল, হাত বা অন্য যে কোন বস্তুকে চিনতে পারে। ঘড়িতে টিভি ॥ জেমস বন্ড সিরিজের ১৯৮৩ সালের মুভি ‘অক্টোপাস’এ বন্ডকে টিভি স্ক্রিন লাগানো সেকো ঘড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। কোন তারের সংযোগ ছাড়াই ঘড়িতে ভিড়িও বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল যা আফগান প্রিন্স কামাল খানকে ধরার ক্ষেত্রে বন্ডকে সাহায্য করেছিল। প্রায় ৩০ বছর আগে বন্ড সিরিজের ব্যবহৃত এই প্রযুক্তি বর্তমানে নির্মাতা কোম্পানি এ্যাপল বা স্যামসাংয়ের সৌজন্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে।
×