ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাকা মুজাহিদ ও নিজামীর ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে নবেম্বরেই

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

সাকা মুজাহিদ ও নিজামীর ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে নবেম্বরেই

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ভাগ্য নির্ধারণ নবেম্বরে। সাকা ও মুজাহিদের রিভিউ শুনানি ২ নবেম্বর আর নিজামীর ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে আপীল শুনানি ৩ নবেম্বর শুরু হবে। রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে নবেম্বরেই এ তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। রাষ্ট্রপক্ষের মতে সাকা- মুজাহিদের শুনানি দ্রুত শেষ হবে। অন্যদিকে নিজামীর আপীল শুনানি নবেম্বরের মধ্যেই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পর রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করা হতে পারে। সাকা মুজাহিদের রিভিউ শুনানি শেষে আসামি পক্ষের আবেদন খারিজ হলে এক মাত্র পথ থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা। রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ করলে কারাগার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নবেম্বরে ননী ও তাহেরের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১৫ মামলায় অর্ধশতাধিক আসামির বিচারের সম্মুখীন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টে অবকাশকালীন ছুটি চলছে। ১ নবেম্বর সুপ্রীমকোর্ট খুলবে। আদালত খোলার পর ৩৩ দিন কার্যদিবস থাকবে। পুরো নবেম্বর আদালত খোলা থাকার পর পুনরায় ১৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত বন্ধ থাকবে। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মুজাহিদের রিভিউ শুনানি দ্রুত শুরু করতে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। ২০ অক্টোবর সকালে রাষ্ট্রপক্ষের করা এক আবেদনের শুনানি নিয়ে অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২ নবেম্বর দিন ধার্য করেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, শুনানির জন্য দ্রুত দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মামলাগুলোরও দ্রুত শুনানি হয়েছে। সময় কতদিন লাগবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা আদালতের বিষয়। তবে আমার মতে সময় লাগার কথা নয়। অন্যদিকে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আটজনের সাফাই সাক্ষ্য নেয়ার যে আবেদন করেছেন, সেই আবেদনও রিভিউয়ের সঙ্গে আদালতে যাবে। রিভিউ শুনানিতে পাঁচ পাকিস্তানীসহ আটজনের সাফাই সাক্ষ্য নেয়ার জন্য তাদের নামে সমন জারির এই আবেদন করেন সাকা চৌধুরী। তাদের নাম দেয়া হয়েছে তারা হলেন, পাকিস্তানের স্থপতি মুনিব আরজুমান্দ খান, পাকিস্তানের ডন গ্রুপের চেয়ারম্যান আমবর হারুণ সায়গল, পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ভিকারুননিসা নূনের নাতি রিয়াজ আহমেদ নূন এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মিয়া সুমরো। বাকি তিনজন হলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক কূটনীতিক এম ওসমান সিদ্দিক, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শামীম হাসনাইন ও তার মা জিনাত আরা বেগম। এদিকে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এ প্রচার সম্পাদক তুষার আমীন এক বিবৃতিতে বলেছেন, পূর্ণ বিচারিক কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর একজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে এ ধরনের আর্জিকে প্রভাবিত হবে। উল্লেখ্য, গত ১৪ অক্টোবর রিভিউ আবেদন করেন দুই যুদ্ধাপরাধী। পরদিন আবেদনের শুনানির দিন নির্ধারণের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। পরদিন তাদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর ওই দিনই কারা কর্তৃপক্ষ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজাহিদ এবং গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়। সাকা চৌধুরী ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক হত্যা ও গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া বিএনপির শীর্ষ নেতা সাকা বাহিনীর (নিজস্ব বাহিনী) প্রধান স্বঘোষিত ব্রিগেডিয়ার সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ২৯ জুলাই ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ মামলার রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেয়া হলো। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে সাজা বহাল রাখা হলো। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি ঘটনায় সাকা চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে সকল অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো, ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নং অভিযোগ। এছাড়াও প্রসিকিউশন পক্ষ সাক্ষী না দেয়াতে যে অভিযোগগুলো নিয়ে আদালত কিছু বলেননি সেগুলো হলো, ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নং অভিযোগ। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সাকা চৌধুরী ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর সুপ্রীমকোর্টে আপীল দায়ের করেন। মুজাহিদ ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টারমাইন্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপীল খারিজ করে ১৬ জুন মৃত্যুদ- বহাল রাখেন আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন। বুদ্ধিজীবী হত্যায় এটাই আপীল বিভাগের প্রথম রায়। উল্লেখ্য, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোন ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে উচ্চ আদালত তাকে মৃত্যুদ- বহাল রাখলেন। আপীল বিভাগ রায়ে অভিযোগ-১ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আসামি মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন। অভিযোগ-২ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৫ বছরের সাজা বহাল রেখেছেন। অভিযোগ-৫-এ বদি, রুমিসহ অন্যদের হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- বহাল রেখেছেন। অভিযোগ-৬ ট্রাইব্যুনালের দেয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ-৭-এ বকচর হত্যাকা-ে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন করাদ- প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ (২ ও ৪) প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগের দায় থেকে তাকে খালাস দেন। অন্যদিকে ৫টি অভিযোগ (১, ৩, ৫, ৬, ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩নং অভিযোগে ৫ বছর ও ৫নং অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। ৬ ও ৭নং অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ১নং অভিযোগটি ৬নং অভিযোগের সঙ্গে একীভূত করায় ১নং অভিযোগে পৃথক কোন দ- দেননি ট্রাইব্যুনাল। মতিউর রহমান নিজামী ॥ মতিউর রহমান নিজামীর পরবর্তী শুনানির জন্য ৩ নবেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত উভয়পক্ষের আইনজীবীদের লিখিতভাবে যুক্তিতর্কের সার-সংক্ষেপ জমা দিতে বলেন। উল্লেখ্য, এর আগেও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় চট্টগ্রামের একটি আদালত মতিউর রহমান নিমাজীকে মৃত্যুদ- প্রদান করেছেন। ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর দ- থেকে খালাস চেয়ে মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। এ আপীলের এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হচ্ছেন জয়নুল আবেদিন তুহিন। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার আপীলে মোট ১৬৮টি যুক্তি দেখানো হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সম্পত্তি ধ্বংস দেশত্যাগে বাধ্য করায় আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় নিজামীকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনাল ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে নেত্রকোনা জেলার দুই রাজাকার মুসলীম লীগ নেতা আতাউর রহমান ননী ও নেজামে ইসলামের ওবায়দুল হক তাহেরের মামলাটিও প্রায় শেষের দিকে। তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২২ সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। নবেম্বর মাসেই এ মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১৫ মামলার অর্ধশতাধিক আসামিকে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। কিছু মামলা বিচারের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধে তদন্ত প্রতিবেদন জমার অপেক্ষায় রয়েছে ১৯ আসামির মামলাটি। জামালপুরে আট আসামি, যশোর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনসহ ৫ জন। কিশোরগঞ্জে যুদ্ধপরাধের অভিযোগে পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
×