ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গদ্য আচার্য

অপরাজেয় তারুণ্যের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৭ অক্টোবর ২০১৫

অপরাজেয় তারুণ্যের ইতিহাস

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যের কথা বললেই সবার প্রথমে যে দৃশ্যটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে, তা হলো তিনটি নিশ্চল মূর্তি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটির নাম অপরাজেয় বাংলা। এই তিনজন তরুণের দু’জন পুরুষ, একজন নারী। পুরুষের একজনের কাঁধে রাইফেল, লম্বা এই তরুণের পরনে কাছা দেয়া লুঙ্গি, ডান হাতের মুঠোয় একটি গ্রেনেড। তার বাম দিকে অপেক্ষাকৃত খর্বকায় আরেক তরুণ, তার পরনের প্যান্ট বুঝিয়ে দেয় সে একজন শহুরে। এর রাইফেলটি হাতে ধরা। লম্বা তরুণের ডান পাশে কুচি দিয়ে শাড়ি-পরিহিতা এক তরুণী, তার কাঁধে একটি ফার্স্টএইড বক্স। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিরোধ, মুক্তি ও সাফল্যের প্রতিকৃতি এই অপরাজেয় বাংলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশীদের সংস্কৃতি চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠা অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ ইতিহাস তুলে ধরেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল তাঁর ‘অপরাজেয় বাংলা’ তথ্যচিত্রে, অপরাজেয় বাংলার নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের জবানিতে। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চেতনার উৎসবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্থানে বর্তমানে অপরাজেয় বাংলা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ছিল আরেকটি ভাস্কর্য। কোন কারণে সেটা ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেন আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণের। সময় ১৯৭৩ সাল। নাট্যাভিনেতা ম. হামিদ তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক। অনেক খোঁজখবর করে তারা খুঁজে বের করেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে। তিন মাস সময় নিয়ে তিন ফুট উঁচু একটি রেপ্লিকা মূর্তি তৈরি করেন তিনি। এই মূর্তি তৈরিতে মডেল হিসেবে সময় এবং শ্রম দেন অপরাজেয় বাংলার মধ্যমণি কৃষক মুক্তিযোদ্ধারূপে বদরুল আলম বেনু, অপরাজেয় ছাত্রমূর্তি মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররূপে সৈয়দ হামিদ মকসুদ এবং অপরাজেয় নারী মূর্তি মুক্তিযোদ্ধা সেবিকারূপে হাসিনা আহমেদ। সে সময় পত্রিকায় এই ভাস্কর্যটি নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, তাঁর প্রবন্ধের নাম অনুসারে ভাস্কর্যটির নাম হয়ে যায় ‘অপরাজেয় বাংলা’। ভাস্কর্যটি যে তিনকোণা বেদির উপরে স্থাপিত তার নক্সা করেন স্থপতি রবিউল হুসাইন। প্রথম প্রতিকৃতির প্রায় চারগুণ আকারের বর্তমান ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ পান প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ এ্যাসোসিয়েটস। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে বন্ধ হয়ে যায় এর নির্মাণ কাজ। ১৯৭৯ সালে পুনরায় ভাস্কর্য তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সে বছরই সম্পন্ন করা হয় বাকি কাজ। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে উদ্বোধন করা হয় অপরাজেয় বাংলা, উদ্বোধন করেন যুদ্ধাহত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। অপরাজেয় বাংলা তথ্যচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এর নির্মাণ ইতিহাস বর্ণিত হলেও এর মূল বিষয় ভাস্কর্য নির্মাণ কাহিনী নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশীদের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সাংস্কৃতিক চেতনা এবং ঐক্য। ১৯৭৩ সালে শুরু হয়ে ১৯৭৯ সালে উদ্বোধনের মাধ্যমে যে অপরাজেয় বাংলার সৃষ্টি তা হুমকির মুখে পড়েছিল ১৯৭৭ সালের আগস্টে। ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টে বর্শা নিক্ষেপরত একটি মূর্তি স্থাপনকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে স্থাপনা হিসেবে গণ্য করে প্রতিবাদ করে এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল কিছু গোষ্ঠী এবং এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন অপরাজেয় বাংলা ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দেয় তারা। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির এই ভাস্কর্য নির্মূলের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী পক্ষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশি হস্তক্ষেপে শান্ত হয়েছিল সে সময়ের পরিস্থিতি এবং বাকি কাজ সম্পন্ন হয় কোন বাধা ছাড়াই। ভাস্কর্য এবং তথ্যচিত্র অপরাজেয় বাংলার নির্মাণে আরেকটি মানুষের নাম জড়িয়ে আছে তিনি হলেনÑ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আশফাক মুনীর মিশুক ওরফে মিশুক মুনীর। সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল প্রয়াত এই চিত্রগ্রাহক ১৯৭৯ সালের নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু হলে প্রায় এক বছর দিনে-রাতে এর সঙ্গে থেকে ছবি তোলেন। ছবি তোলার উদ্দেশ্য ফটোগ্রাফি শেখা হলেও কালের বিবর্তনে এখন সেই ছবিগুলোই আজ ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
×