ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ু পানি মাটিতে কোন দূষণের আশঙ্কা নেই

পরিবেশের সব শর্ত মেনেই রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৭ অক্টোবর ২০১৫

পরিবেশের সব শর্ত মেনেই রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিবেশ অধিদফতরের ৬৬ শর্তর সব মেনেই রামপালে কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব শর্তের অনেকই মানা হয়েছে বাকিগুলো নির্মাণ এবং উৎপাদন পর্যায়ে মানা হবে। সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণের কথা ভেবেই বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি। সোমবার বিকেলে রাজধানীর বিদ্যুত ভবনে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে তথাকথিত গবেষণার নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগ এবং বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি যৌথভাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরিবেশের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে বায়ু, পানি এবং মাটিতে কোন দূষণ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী নামের একজন শিক্ষক রামপাল নিয়ে একটি তথাকথিত গবেষণার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বিষয়টি উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসমৃৃদ্ধ। এ ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে যে ধরনের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার তা একজন শিক্ষক এবং গুটিকয়েক ছাত্রের রয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিভ্রান্তিকর এই গবেষকদের ডেকে প্রকৃত বিষয় বোঝানো হয়েছে তখন তারা কোন কথা বলতে পারেননি। কিন্তু তারা নিজস্ব অবস্থান থেকে আবার সরে আসছে না। তারা প্রকৃত বিষয় অনুসন্ধান না করে নিজেদের মনগড়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উস্কানি দিয়ে আসছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ড. আব্দুল্লাহ হারুন নামের ওই তথাকথিত গবেষক বলছেন, রামপালে খোলা জাহাজে কয়লা পরিবহন করলে বাতাসে ধুলা ছড়াবে। কিন্তু খোলা জাহাজে কয়লা পরিবহন করাই হবে না। তিনি কয়লা পোড়ানোর ফলে ছাই উৎপাদন হবে সেই ছাই বাতাসে ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করবে বলে গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ছাই উৎপন্ন হবে তার ৯৯ দশমিক ৯ ভাগই আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে ধরে ফেলা হয়। বাসাতে যদি ছাই না ছড়ায় তাহলে পরিবেশ দূষণ হবে কী করে? উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী মহাজোট সরকারের শেষ দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। কিন্তু কোন্ প্রযুক্তিতে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ হবে তাই তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে জানাতে পারেননি। এই আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীই রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পরিবেশবাদীদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। এখন পরিবেশবাদীরা তাদের সব আন্দোলনে আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীর একপেশে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন। বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ে সরকার এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, আমরা সকলের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করতে চাই। কিন্তু তা যথোপযুক্ত হতে হবে। ড. হারুনের গবেষণাকে তিনি ঘোড়ার আগেই গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো বলে উল্লেখ করেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুত সঞ্চালন ব্যবস্থার সুষম উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে রামপালকে বেছে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বিদ্যুত কেন্দ্রটি সুন্দরবন করছি না রামপাল করছি। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল ভট্টাচার্য জার্মানি, জাপান, তাইওয়ান এবং ভারতের কয়েকটি কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রের ছবি দেখিয়ে বলেন, সব বিদ্যুতকেন্দ্রই শহরের মধ্যে অবস্থিত। সব বিদ্যুতকেন্দ্র নদীর পানি ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদন করছে। পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা থাকলে উন্নত দেশগুলো নিশ্চয়ই শহরের মধ্যে কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করত না। তিনি বলেন, সকল ধরনের নিয়ম মেনে, পরিবেশের উৎকর্ষ বজায় রেখে সর্বোপরি কমদামে বিদ্যুত দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্তত ২৫ থেকে ৪০ বছর যা বাংলাদেশের উন্নয়নকে গতিশীল করবে। তিনি বলেন, বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গতি ঠিক রাখতে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এক দশমিক ৬৯ ভাগ হতে হয়। বাংলাদেশে জনপতি বিদ্যুত ব্যবহারের পরিমাণ ৩৭১ কিলোওয়াট/আওয়ার সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ হাজার ৫৩৯ কিলোওয়াট/আওয়ার। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে যেতে হলে ওই পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সব চেয়ে বেশি পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র। যারা তাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৪০ ভাগই কয়লায় উৎপাদন করে। এখন প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হয় যার মধ্যে চার লাখ মেগাওয়াটই আসে কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে। বিশ্বে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুত খাতে কয়লায় বিনিয়োগ হবে এক হাজার ২০০ বিলিয়ন ডলার, পরমাণুতে হবে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার এবং গ্যাসে বিনিয়োগ হবে ২৮৪ বিলিয়ন ডলার। গ্যাস সঙ্কটে বাংলাদেশের সামনে কয়লায় বিদ্যুত উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি। তিনি রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের আইনানুযায়ী সংরক্ষিত এই বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন স্থাপনা করা যাবে না। কিন্তু সেখানে আমরা করছি ১৪ কিলোমিটার দূরে। যেটা সুন্দরবনের কাগজে-কলমে সীমানা নির্ধারণ রয়েছে। ইউনেস্কো ঘোষিত সীমানা থেকে বিদ্যুতকেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। তিনি বলেন, আমরা পত্রপত্রিকায় এ্যাশ (ছাই) কেনার জন্য আগ্রহপত্র চেয়েছিলাম। যে পরিমাণ ছাই প্রতিদিন উৎপন্ন হবে তার চারগুণ কেনার মতো ক্রেতা রয়েছে। ছাই যে পুকুরে রাখা হবে সেখানের প্রাচীর কনক্রিট নির্মিত হওয়ায় ছাইয়ের সঙ্গে ভূতলের পানি বা মাটির স্পর্শের সম্ভাবনা নেই। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মোঃ শাহজাহান বলেন, আমরা দুই বছর ধরে বিদ্যুতকেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করেছি। মোট আটবার এটিকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। আমরা মোট ৬৬টি বিষয়ে আমাদের মতামত দিয়েছি। এই সকল মতামত গ্রহণ করেই বিদ্যুতকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। পরিবেশের প্রশ্নে আমরা কোন ছাড় দেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যুতকেন্দ্রটির কাজ সর্বক্ষণিক তদারক করবে পরিবেশ অধিদফতর। সংবাদ সম্মেলনে জনানো হয়, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিদ্যুত উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে কয়লাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৪০ভাগ, জার্মানি ৪১ ভাগ, জাপান ২৭ ভাগ, ভারত ৬৮ ভাগ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯৩ ভাগ, অস্ট্রেলিয়া ৭৮ ভাগ, মালয়েশিয়া ৩৩ ভাগ এবং চীন ৭৯ ভাগ বিদ্যুত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন করে থাকে, সেখানে বাংলাদেশ করে মাত্র ২ দশমিক ২৬ ভাগ। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। দেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্তের দ্বারোন্মোচনকারী এ প্রকল্প নিয়ে একটি মহল ও কতিপয় ব্যক্তি বা সংগঠন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার ও কর্মকা- পরিচালনা করছে যা ভিত্তিহীন, দেশের স্বার্থবিরোধী ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়। বিদ্যুতকেন্দ্র হতে সুন্দরবন নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত। সুন্দরবনের ইউনেস্কো হেরিটেজ থেকে বিদ্যুতকেন্দ্রটি ৬৯ কিলোমিটার দূরে এবং সুন্দরবনের প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে অত্যাধুনিক আল্ট্রা সুপার থারমাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে এখান থেকে পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়া তৈরি হবে না বা ছাই উড়ে বায়ু দূষণেরও সম্ভাবনা নেই, এখানে ব্যবহারের জন্য যে কয়লা আনা হবে তা আবৃত অবস্থায় পরিবহন করা হবে, ফলে পানি বা বায়ু দূষিত হবে না। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পানি প্রক্রিয়াকরণ করা হবে, ফলে কোন দূষিত বা গরম পানি নদীতে ফেলা হবে না। বিদ্যুতকেন্দ্রে ব্যবহৃত চিমনীর উচ্চতা ২৭৫ মিটার হওয়ায় বায়ু দূষণের কোন সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া পশুর নদীর খুব অল্প পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হবে, যা কোনভাবেই নদীর জন্য হুমকি হতে পারে না। এ বিদ্যুতকেন্দ্র হতে এলাকার মানুষ, সুন্দরবন বা এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, পশুর নদী, স্থানীয় এলাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুতকেন্দ্রটি বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণকারী সংস্থাসমূহের সকল প্রকার নিয়ম-কানুন মেনেই নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরিবেশগত বিষয়সমূহে বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডের চেয়েও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মান অনুযায়ী এই বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনা করার ও পরিচালনা করার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত ২ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে কয়লাবিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রকল্পের বিদ্যুতকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট তিন পয়সা হিসাবে লেভী ধার্য করে ওই অর্থ দিয়ে একটি উন্নয়ন তহবিল গঠনের খসড়া নীতি গ্রহণ করা হয়। এই নীতি বাস্তবায়ন করে তার সুফল প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা সিএসআর কর্মসূচীর আওতায় কোম্পানি ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর জন্য ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেছে যা এ জনপদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করেছে।
×