ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চন্দনা টিয়া

সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা, দেখা মেলে গ্রীষ্মে এ দেশে বিপন্ন

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৭ অক্টোবর ২০১৫

সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা,  দেখা মেলে গ্রীষ্মে এ দেশে বিপন্ন

এস এম ইকবাল ফেব্রুয়ারি-জুলাই অধিকাংশ পাখির প্রজনন সময়। এ সময়টায় পাখিদের বাসা, ডিম এবং বাচ্চাদেরও দেখার সুযোগ মেলে। ছবি তোলার আশায় সম্প্রতি একাই চলে গেলাম বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের ডেমাজানী বাজার এলাকায়। বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর পাখির সমাগম ওই এলাকায়। বাজারে ঢোকার প্রবেশ পথে রাস্তার বাঁকে প্রাক্তন তহসিল অফিস প্রাঙ্গণে প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো মেহগনি গাছ। যে গাছে সবুজ টিয়া পাখি আসে, বাসা বাঁধে, তা আমি গত বছর জেনেছি। সে জন্য মেহগনি গাছের সবুজ টিয়াগুলোর কোলাহল আমার তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করল না। গাছের সীমানা পার হতেই বিকট কর্কশ শব্দ ক্রি-এ্যাক, ক্রি-এ্যাক। মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালাম। পাখির এ ধরনের ডাক আমি আগে কখনও শুনিনি। ততক্ষণে গোধূলি আলোর মাত্রা আরও কমে এসেছে। আধো আলো-ছায়ায় শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম। একটু খুঁজতেই দেখলাম একটি টিয়া গাছের কোঠরের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে ক্রি-এ্যাক, ক্রি-এ্যাক; আর ৩-৪টি সবুজ টিয়া অনবরত তাকে আক্রমণ করছে। আমার বুঝতে দেরি হলো না এখানে বাসা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। কিন্তু ওর ডাক আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, যা সাধারণ টিয়ার মতো নয়! দেরি না করে শব্দের উৎসের টিয়াটির দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরায় বন্দী করলাম। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, যে পাখিটি আমার ভিডিও ক্যামেরায় বন্দী হলো তা দেশের জনগণকে জানানো অতি জরুরী। চা স্টলে বসে কয়েকবার ভিডিওফুটেজ দেখলাম আমি, নিশ্চিত হতে পারছিলাম না ওর দু’ডানার গোড়ায় সিঁদুর আলতা মেশানো ছোপ, নাকি পাতার ছায়া। টিয়াটির সঠিক পরিচয় পাওয়ার জন্য পরদিন সকালে আবার সেই গাছতলায় গেলাম, কিন্তু কর্কশ ডাকওয়ালা টিয়া পাখিকে পাওয়া গেল না। বসে পড়লাম গাছের সঙ্গে লাগানো সাইকেল মেকারের কারসাজি দেখতে। কোন খবর নেই পাখিটির। ভিডিও দেখালাম আশপাশের লোকজনদের। সবার এক কথা, এ তো টিয়া! ভিডিও ক্লিপটি চলার এক ফাঁকে ক্রি-এ্যাক শব্দ শুনে এগিয়ে এলেন সাইকেল মেকার স্বপন। সে প্রতিদিনই এ রকম ডাক এই গাছে শুনেছে। কিন্তু কোন পাখি ডাকছে, তা নিশ্চিত নয়। কোন সমাধান না পেয়ে আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন বেলা অনেকটা গড়িয়েছে। আছরের নামাজের আজান তখনও শুরু হয়নি। ভাবছি আজকের মতো অপেক্ষার পালা শেষ করব কিনা। স্বপন এসে বলল, স্যার, এ গাছের টিয়াগুলো সারাদিন মাঠেঘাটে চরে বেড়ায় আর বিকেল থেকে গাছে আসতে শুরু করে। স্বপনের কথায় যুক্তি আছে, গত দিন সন্ধ্যায় টিয়াদের কলরব সে কথা মনে করিয়ে দিল। দূর আকাশের বিশৃঙ্খল শব্দ আমার এলোমেলো ভাবনায় ছেদ ঘটাল। সেই ‘সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা’ এলেন সেই একই সুরে ডাকতে ডাকতে ক্রি-এ্যাক, ক্রি-এ্যাক। ডালে বসলেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাত দিলেন। ফটোগ্রাফ দিলেন। আমার আশা পূরণ হলো। বাংলাদেশের মহাবিপন্ন চন্দনা টিয়া দেখার। ২০১৩ সাল থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে আসছি চন্দনা টিয়াদ্বয়কে। আমার ওখানে ঘন ঘন উপস্থিতি, ভিডিওচিত্র ধারণ, মাঝে মধ্যে খোঁজখবরে জনগণের কৌতূহলের জবাব না দিয়ে আর পারলাম না। এভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চন্দনা টিয়ার খবর। সে সঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগল এ গাছের পাখিদের ইতিবৃত্ত এবং ভয়ঙ্কর সব পাখি ব্যবসায়ীদের খবর। অনেকবার চুরি হয়েছে চন্দনার বাচ্চা, যা সাধারণ জনগণ টিয়া বলেই চিনত। শিকারী ঠিকই চিনেছে টিয়াকে, সেজন্য এদের প্রজনন বৃদ্ধি না ঘটে এক জোড়া চন্দনাই বরাবর রয়ে গেছে। এ পাখির মহাবিপন্নের কথা স্থানীয় এলাকাবাসীকে বোঝাতে আমার বেশি বাক্য ব্যয় করতে হয়নি। সে সঙ্গে চন্দনাকে রক্ষার জন্য ওয়াইল্ডলাইফ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সেভ টিমের (ওয়েস্ট) শাখা খুলে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে চন্দনার নজরদারি পুনরায় শুরু করি। নিখুঁতভাবে এদের প্রজনন আচরণ পর্যবেক্ষণ করি। পুরো প্রজননকাল ভিডিওচিত্র ধারণ করেছি। এ মেহগনি গাছে মোট ৫টি চন্দনার যাতায়াত আছে। এর মধ্যে দুটি পুরুষ এবং ৩টি স্ত্রী। তার মধ্যে এক জোড়া দম্পত্তি মেহগনি গাছে বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়েছে। কারণ এদের দেহের আয়তনের খোঁড়াল এ গাছে শুধু একটি ছিল। বাকি তিনটি কোথায় বাসা বেঁধেছে তা তখনও আমার অগোচরে। তবে প্রতিদিন একবার করে পাখি তিনটি মেহগনি গাছে আসত, কিছু সময় অবস্থান করার পর অথবা দম্পত্তি যুগলের তাড়া খেয়ে আবার অন্যত্র চলে যেত। এ বছরের দুটো বাচ্চাসহ মোট ৭টি পাখির আনাগোনা আছে এই শতবর্ষী মেহগনি গাছে। এলাকাবাসীর এবং আমার কড়া নজরদারির মধ্যেও গত এপ্রিল মাসের কোন এক ভরদুপুরে সুযোগ বুঝে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে চন্দনার বাচ্চা দুটো চুরি হয়ে গিয়েছিল। সংবাদ পেয়ে আটজন পুলিশ ও সাংবাদিক নিয়ে দ্রুত উপস্থিত হলাম ডেমাজানী বাজারে। দুই ঘণ্টা পুলিশী জেরায় বের হলো বাচ্চা দুটো, রাখা হলো স্ব স্থানে। মা-বাবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় আটাশ ঘণ্টা। মোবাইলে যোগাযোগ করি শরীফ খানের সঙ্গে। তার পরামর্শ মতো কাজ করি। তারপর দম্পতি পুনরায় বাচ্চা দুটোর লালন পালন শুরু করে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কড়া নজরদারির মধ্য দিয়ে বাচ্চা দুটো বাসা থেকে বেরিয়েছে, সে সঙ্গে নতুন চিন্তা ভর করেছে। কিভাবে কোথায় হবে বাচ্চা দুটোর পরবর্তী প্রজনন স্থান? আর বাকি তিনটি টিয়াই বা কোথায় বাসা বেঁধেছে? নাকি প্রজনন আবাসস্থলের অভাবে এরা ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াবে? এদের প্রজনন বাসা হতে হবে অনেক উঁচুতে, বাসার মুখ এবং গভীরতা হতে হবে অনেক বড়। সেজন্য এরা সাধারণ কাঠঠোকরাদের তৈরি বাসা ব্যবহার করতে পারে না। আর পারে না নিজে বাসা তৈরি করতে। আমি লক্ষ্য করেছি ওই মেহগনি গাছের একটি বাসাকে চন্দনা দম্পতি ধরে রাখার জন্য ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, বড়ো কাঠঠোকরা এমনকি দোয়েলের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। শুধু কি তাই! আরাম আয়েশ করে ডিমগুলো যে তা দেবেÑ সে উপায়ও নেই। দিনে কতবার যে মা চন্দনা বাসা থেকে বেরিয়ে শালিক তাড়িয়েছে হিসাব নেই। আমিও বিরক্ত হয়ে ঢিল দিয়ে শালিক, কাঠঠোকরা তাড়িয়েছি। কোন উপায় নেই যে, চন্দনা দম্পতি একসঙ্গে উড়ে আহার সেরে আসবে। সুযোগ পেলেই শালিক, কাঠঠোকরারা বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। সত্যিই চন্দনার সংসার অনেক বেদনাদায়ক। এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রাকৃতিক ঘটনা। এমতাবস্থায় ডেমাজানী বাজারের এই মেহগনি গাছে চন্দনার কলোনি গড়ে তোলার জন্য আমি ধারাবাহিকভাবে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করি। প্রথমত, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, বড় কাঠঠোকরা, দোয়েলের নিরাপদ প্রজননের জন্য মেহগনি গাছের আশপাশের গাছগুলোতে কম উচ্চতায় গত মে মাসের প্রথমদিকে ৪০টির মতো কলস বেঁধে দেই। পরের দিন বিকেলে সংবাদ এলো শালিক, কাঠ শালিক, দোয়েল, পেঁচা, কাঠঠোকরাসহ অন্যান্য কোঠরে প্রজননকারী পাখিরা এসব কলসে প্রজননে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে চন্দনার সঙ্গে এসব পাখির প্রজননের সময় বাসা দখল নিয়ে আর প্রতিযোগিতা হবে না। তবে এ কলসে চন্দনা প্রজনন করবে না। সফল হলো আমার প্রথম ধাপ। চন্দনার প্রজননের জন্য বিশেষ প্রযুক্তিতে মাটির এবং কাঠের বাসা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। এসব বাসা তৈরি হলে দ্বিতীয় ধাপে মেহগনি গাছের উঁচু ডালে লাগানো হবে, যাতে চন্দনা নিরাপদে প্রজনন করবে, বৃদ্ধি পাবে এদের সংখ্যা। এভাবে ভবিষ্যতে ডেমাজানীতে গড়ে উঠবে মহাসঙ্কটাপন্ন চন্দনার নিরাপদ কলোনি। ফলে এ পাখি দেখার সুযোগ পাবে দূর-দূরান্তের বহুলোক এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম। সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ॥ বাংলা নাম চন্দনা টিয়া, মহাবীর আলেকজেন্ডার চন্দনা টিয়া পাখিটি পাঞ্জাব থেকে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাসহ অনেক জায়গায় ছড়িয়ে দেন এবং বিখ্যাত ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের রাজকীয় পুরস্কার বা প্রতীক হিসেবে দেয়ার প্রচলন করেন। সেই থেকে এর ইংরেজী নাম হয়-অষবীধহফৎরহব চধৎধশববঃ, বৈজ্ঞানিক নাম : চংরঃঃধপঁষধ বঁঢ়ধঃৎরধ (ল্যাটিন : চংরঃঃধপঁষধ= তোতা; গ্রিক : বঁঢ়ধঃৎরধ= সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা)। চন্দনার দেহের দৈর্ঘ্য ৫৩ সেমি বা ২১ ইঞ্চি। চন্দনার ৫টি উপ-প্রজাতি আছে। এর মধ্যে চ. ব. হরঢ়ধষবহংরং বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এদের খাদ্য ফল, ফুলের অংশ, শস্যদানা ইত্যাদি। ওজন ২৫০ গ্রাম। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ফোটে ২৩-২৭ দিনে। শরীফ খান ও প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল খান জানাচ্ছেনÑ ইদানীং ঢাকা শহরের বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, শিশু একাডেমি এলাকায় এদের দেখা যায়। বাসাও করে। এটা একটি সুসংবাদ পাখিপ্রেমীদের কাছে। কেননা চন্দনারা মহাবিপন্ন পাখি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে দুর্লভ। বাংলাদেশের এটিই সবচেয়ে বড় টিয়া।
×