ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর আড়ালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে জামায়াত

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর আড়ালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে জামায়াত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের মতো সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অযোগ্য হলেও বসে নেই জামায়াত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলেও জামায়াত-শিবির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়ার কৌশল নিয়েছে। এ লক্ষ্যে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনটি। সূত্রগুলো বলছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপ দিচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা আমীর ও সেক্রেটারিদের অনেকেই শীর্ষ নেতাদের কাছে লিখিত চিঠি পাঠিয়ে দাবি করেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তারা জয়ী হবেন। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও তারা নির্বাচনের পক্ষে। সরকারের সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্ত অনুসারে, আগামীতে স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও প্রতীকে হবে। ফলে সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে কেবল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোই তাতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ফলে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, দলীয় পরিচয়ে দলের প্রতীকে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী আইনে যদি সংশোধনী আনা হয় তাহলে অনিবন্ধিত বা নিবন্ধন বাতিল হওয়া কোন দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। সর্বোচ্চ আদালতে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীও দলীয় প্রতীকে অংশগ্রহণ করতে না পারারই কথা। সরকার যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করতে চায় তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় ও জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আইনের অনুলিপি প্রজ্ঞাপন আকারে আমাদের পাঠালে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ হারায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা এ দলটি। তবে দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে না হওয়ায় এতদিন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুযোগ পেয়ে আসছিল এ দলটির প্রার্থীরা। এবার সে সুযোগও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নির্বাচনী আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য পাঁচটি আইন সংশোধনের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন। এটা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন সব ক্ষেত্রেই। এদিকে এখন পরিষ্কার যে, সংশোধনী চূড়ান্ত হলে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা বা জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির অংশ নেয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না। তাহলে এখন দল হিসেবে আসন্ন স্থানীয় নির্বাচনে কি করবে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের নেতাকর্মীরা? বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দিকে তাকিয়ে থাকবে নাকি নিজেরাই কোন সিদ্ধান্ত নেবে? এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে সরকারের উদ্যোগের পরপরই। জামায়াত-শিবিরের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে স্থানীয় নির্বাচনে ভূমিকা কী হবে? জামায়াতের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন একটি প্রশ্নের বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। মতামত জানিয়েছেন জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আমীর ও সেক্রেটারিরা। স্বতন্ত্র হলেও নির্বাচনের বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে ইতিবাচক উত্তর আসার পরই দলটি প্রয়োজনে জোটের বাইরে গিয়ে এককভাবে নির্বাচনের পক্ষে কাজ শুরু করেছে। তবে নেতারা বলছেন, এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশে ফিরলে তাকে দলের অবস্থান পরিষ্কার করা হবে। তার পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। জানা গেছে, ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে জামায়াত। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করেছে দলটি। দলীয় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডাঃ শফিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে এ কমিটিতে নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল হালিম, নির্বাহী পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুল, মহানগর সেক্রেটারি সেলিম উদ্দিন, ড. রেজাউল করিমসহ কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা কাজ করছেন। জামায়াতের একাধিক নেতা বলছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অংশ নিতে উৎসাহী। এজন্য জাতীয় নির্বাচনের মতো বর্জন করলে স্থানীয় রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। নির্বাচনের জন্য গোপনে নিজেদের প্রস্তুত করলেও অবশ্য জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডাঃ শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্থানীয় সরকারের সব স্তরে দলীয় প্রতীক ও দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করার জন্য যে সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদে গ্রহণ করা হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে সবার আগে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেরও দাবি জানান জামায়াত নেতা। বিবৃতিতে দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের বিরোধিতা করলেও জানা গেছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও কেন্দ্র থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে গেল বছর উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলের কথাও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের। ওই নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ৩৪ জন সমর্থিত প্রার্থী, ১৩৪ জন পুরুষ ভাইস-চেয়ারম্যান ও ৪৫টির বেশি নারী ভাইস-চেয়ারম্যান পদে দলটির সমর্থিতদের বিজয়ী হয়েছিল বলে দাবি করছে দলটি। সে হিসেবে এবার পৌরসভা ও আগামী দিনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ‘ভাল’ ফলাফল আশা করছে দলটি। এদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে অংশ নিলে নিজেদের অবস্থান কতটুকু নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়েও চিন্তিত জামায়াত-শিবির নেতারা। শীর্ষ নেতারাই বলছেন, দলীয় বা জোটগত যেভাবেই হোক বিপাকে পড়তে হবে। যেহেতু নির্বাচন কমিশনে দলীয় নিবন্ধন স্থগিত, সে কারণে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নিজেদের প্রার্থীদের পরিচয় দিতে হবে। এমন অবস্থায় বিএনপি কয়টি এলাকা জামায়াতকে ছাড়বে, সে প্রশ্ন আছে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সময় জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল। এ সময় তারা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে তাদের কার্যক্রম চালায়। জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীকে আবারও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। এরপর ২০১৩ সালে ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে জামায়াত দলীয়ভাবে কোন নির্বাচনে অংশ নেয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। তবে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছে জামায়াত। সেটির এখন নিষ্পত্তি হয়নি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব মওলানা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে এক রিট পিটিশন দায়ের করেন। কয়েক দফা শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ১ আগস্ট এক রায়ে, জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দেয়াকে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও আইনগত অকার্যকর মর্মে ঘোষণা করায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়।
×