ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গী তৈরি করতে হবে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গী তৈরি করতে হবে  -স্বদেশ রায়

১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করার পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যেদিন ভারত সর্বাত্মকভাবে যোগ দেয়- তার আগের দিন বিকেলে কোলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে ছিল ইন্দিরা গান্ধীর জনসভা। ওই সভার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু ওই ভাষণটির সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল, ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ভারতের মানুষ কীভাবে সেই যুদ্ধে মনোবল রাখবে। কীভাবে তার প্রাণশক্তি বাঁচিয়ে রাখবে। অপরিসীম বুদ্ধিমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণে সরাসরি এমনটি বলেননি যে, ভারতের মানুষকে কী করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, ভারতবাসীকে সামনে কঠিন দিন পার করতে হতে পারে। সে সময়ে তারা যেন মনোবল না হারায়। আর এই মনোবল রাখার কথা বলতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন তাঁর ইউরোপের স্মৃতি টেনে এনেছিলেন। তিনি তখন ইউরোপে ছিলেন। সেখানে তিনি দেখেছিলেন, কিভাবে মানুষ লাইন দিয়ে রুটি নিচ্ছে আবার ঠিকমতোই থিয়েটার হচ্ছে, কনসার্ট হচ্ছে। মানুষ সেখানে যাচ্ছে। ভারত যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল তখন ভারত অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। তারপরে তাদের শরীরে ৬২ ও ৬৫’র দুটো যুদ্ধের ক্ষত। সে ক্ষত তখনও ঠিকমতো সারিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে আমেরিকা তার বহু আগে থেকে এমন নীতি গ্রহণ করেছে যাতে ভারত কোনমতেই এশিয়ায় কোন শক্তিশালী দেশ হিসেবে না দাঁড়াতে পারে। এ কারণে ইন্দিরা গান্ধী জানতেন, যদি যুদ্ধ দীর্ঘ হয় তাহলে দরিদ্র ভারতের মানুষকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। সে সময়ে ভারতের মানুষের মনোবল যাতে ভেঙ্গে না পড়ে সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী নির্ভর করেছিলেন সংস্কৃতির ওপর। জওয়াহের লাল নেহরুকন্যা জানতেন, রাজনীতি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে, পরিচালনায় প্রয়োজন কিন্তু মানুষের প্রাণশক্তি বেঁচে থাকে সংস্কৃতিতে। তাই সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো সমাজের ভেতর যত বেশি প্রস্ফুটিত হবে ততই মানুষের প্রাণশক্তি বলীয়ান হবে। আর মানুষ যদি একবার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে সে রাজনীতিবিমুখও হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সমাজ যত বেশি রাজনীতিবিমুখ হয়, রাষ্ট্র তত বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন এ মুহূর্তের পৃথিবীতে একটি বিষফোঁড়া আইএস। আইএস এখন একটি নতুন নামকরণ মাত্র। এক সময়ে যা তালেবান ছিল, তাই পরে আল কায়েদা হয়েছে, আল কায়েদা আবার পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে আইএস হিসেবে। এগুলো কাদের সৃষ্টি তা বুঝতে কারও বাকি থাকার কথা নয়। যারা আফগানিস্তানে তালেবান সৃষ্টি করেছিল তারাই এর জন্মদাতা। এই তালেবান আফগানিস্তানের শুধু নয়, সারা বিশ্বের মানব সভ্যতার প্রাণশক্তির কত বড় ক্ষতি করেছে তা আগামী শতবর্ষ পরে হলেও একদিন হিসাব হবে। সেখানে দেখা যাবে তারা নরহত্যা করে যা ক্ষতি করেছে, সভ্যতাকে ধ্বংস করে, সভ্যতার ঐতিহ্য ধ্বংস করে তার থেকে বেশি ক্ষতি করেছে। আফগানিস্তানের মানুষের প্রাণশক্তি বেড়ে ওঠাকে তারা সরাসরি ক্ষতি করেছে। ঠিক একই কাজ করছে এখন আইএস। তারা প্রতিদিন নরহত্যা করছে ঠিকই কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে, শরণার্থী জীবনে ঠেলে দিয়ে যে ক্ষতি করছে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করছে তারা সিরিয়ার পর্বতের গায়ে, তাদের মিউজিয়ামে রাখা হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতির উপাদান ধ্বংস করে। পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ রোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানান কারণে মারা যায়। মাইগ্রেশন পৃথিবীর ইতিহাসের অংশ। তাই এ ক্ষতি পরিমাপ করা যায়। কিন্তু সিরিয়ার পাহাড়ের গায়ে খ্রিস্টের জন্মেরও চার হাজার বছর আগে যেসব সঙ্গীতকলার যন্ত্রচিত্র খোদাই হয়েছিল এর অবদান মানব সমাজে ও সভ্যতায় কতখানি তা পরিমাপের নয়। মহাসাগরের অতলের মতো। বাংলাদেশও এখন সাংস্কৃতিক সঙ্কটে। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। একে যদি আমরা অস্বীকার করে কোন কাঁচের ঘরে বসে থাকি তাহলে তার চরম মূল্য দিতে হবে। জীবন যদি সংস্কৃতিময় না হয় তাহলে প্রাণশক্তি বাড়বে না জাতীয় জীবনে ও সমাজে। এখন রাজনীতিবিমুখতা ভর করেছে অধিকাংশ মানুষের জীবনে। এই রাজনীতিবিমুখতা আরও বাড়বে। কেউ হয়ত বলতে পারেন, কেন, এখন তো আরও বেশি ঘরে ঘরে রাজনীতি। ঘরে ঘরে রাজনীতির নামে একটি বস্তু আছে ঠিকই কিন্তু তা হলো এক ধরনের পেশীবহুল গোষ্ঠী শক্তির আস্ফালন। আর রাজনীতির নামের গোষ্ঠীবদ্ধ সন্ত্রাসীদের হিংস্র দাঁত। রাজনীতি এখন বড় ক্ষীণকায়। আর রাজনীতি যত ক্ষীণকায় হচ্ছে ততই সভ্যতা ধ্বংসকারী সন্ত্রাসীরা বাড়ছে। বাংলাদেশ কেন এই সাংস্কৃতিক সঙ্কটে পড়েছে? বাংলাদেশের কিন্তু এটা পড়ার কথা ছিল না। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিল বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কিন্তু স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে সামাজিক ক্ষমতায় ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় সর্বত্র যে নতুন শক্তির উত্থান ঘটে সেখানে সংস্কৃতির ঘাটতি ছিল। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অনেক ক্ষতের ভেতর যে লাখ লাখ ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার হারমোনিয়াম পুড়ে গেছে, পুড়ে গেছে বীণা- আর প্রত্যেকের ঘরে থাকা মলাটে বাঁধা কিছু বই। এই দিকটি কিন্তু স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে যে নতুন তরুণ নেতৃত্বের রাজনীতি ও সমাজে উত্থান ঘটে তারা খুব বেশি দেখতে পাননি। তাছাড়া তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি বড় ক্ষমতাধর অংশ ছিল বামপন্থীরা। তারা যেহেতু একটি বিশেষ চিন্তা বা গ-িতে আবদ্ধ তাই তারা তাদের গ-ি থেকে বের হতে পারেনি। অন্যদিকে সব দেশের সাংস্কৃতিক আবহাওয়াকে প্রাণবন্ত রাখতে হলে সময়ের সঙ্গে মেলানোর দিকটি অনেক বড়। প্রতিটি প্রজন্মের মানসিক কম্পন বা বিট ভিন্ন হয়। এজন্য সংস্কৃতি নদীর মতো প্রতিটি জোয়ারের পানিতে সেখানে পলি আসতে হয়। স্বাধীনতার পরে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের এই বিষয়টি তরুণ নেতাদের ভেতর একমাত্র শেখ কামাল ছাড়া অন্য কেউ খুব বেশি ধরতে পেরেছিলেন বলে ইতিহাস বলে না। শেখ কামাল ওই সময় সঙ্গীত, খেলা এমনি সংস্কৃতির এ দিকগুলোতে আধুনিকতা এনেছিলেন। অর্থাৎ ওই সময়ের প্রজন্মের মানসিক কম্পন বা বিটটি তিনি ধরতে পেরেছিলেন এবং সেটাকে এগিয়ে নেয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তা অতি অল্প সময়ের জন্য। কারণ, ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্ট তার পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পরে সামরিক শাসন নামে-বেনামে চলে এদেশে একুশ বছর। জিয়া, এরশাদসহ সকল সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি মূলত পাকিস্তানের আইএসআই-এর এজেন্ট। পাকিস্তানীরা শুরু থেকেই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল; উপনিবেশবাদীরা, শোষকরা এ কাজ করে। যা এখন পশ্চিমারা তালেবান, কাল কায়েদা, আইএস বানিয়ে করছে। জিয়া ও এরশাদ এবং তাদের উত্তরসূরিরা সেই কাজই এ দেশে করেছে। একটি উদাহরণের দিকেই নজর দিলে বোঝা যায়, বিএনপি-জামায়াতের আমলে কিন্তু ক্রিকেট ও ফুটবল পিছিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবার সেটা জেগে ওঠে। এর একমাত্র কারণ সংস্কৃতির এই যে উপাদান খেলা- এর মাধ্যমে মানুষের যে প্রাণশক্তি বাড়বে, আনন্দশক্তি বাড়বে এ পথ তারা সচেতনভাবে নষ্ট করতে চায়। তবে তারপরও বলতে হবে, ২০০৯ থেকে আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতায় এই ২০১৫ অবধি। এ সময়ে এ দেশের সাংস্কৃতিক জগত যেভাবে বিকশিত হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। বরং ১৯৭৫-এর পর থেকে দেশে যে সাংস্কৃতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে মানুষের প্রাণশক্তিকে নষ্ট করার কাজ চলছে সেটাই চলছে জোর কদমে। এর বিপরীতে সরকার বা সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যি অর্থে কোন নেতৃত্ব দিতে পারেনি। শিক্ষাকে সংস্কৃতির অঙ্গ না করে করা হয়েছে রেজাল্টভিত্তিক। যার ফলে কর্মচারী তৈরি হবার পথ সৃষ্টি হয়েছে বেশি কিন্তু শিক্ষার ভেতর দিয়ে প্রাণশক্তিময় মানুষ সৃষ্টির পথ তৈরি হয়নি। বরং শিক্ষাকে অতি বেশি রেজাল্টভিত্তিক করতে গিয়ে মনোজগতে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে সন্তানদের বিকশিত হওয়ার পথ থেকে টেনে এনে কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর রাজার সেই রাজ্যের একজন নম্বরযুক্ত কর্মী তৈরি করায় ব্যস্ত গার্ডিয়ানরাও। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দালান তৈরি করছে। মানুষের মন তৈরিতে নজর দেয়ার সময় তাদের নেই। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মানব সম্পদের পরিবর্তন আনা হয়নি। যাতে করে নতুন প্রজন্মের কম্পন তারা ধরতে পারছে না। দেশের সাংস্কৃতিক জগত এভাবে সঙ্কুচিত হওয়ার অর্থই মনোজগত সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া। প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলা। আর এই প্রাণশক্তি কমে গেছে বলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকা- করার সুযোগ পাচ্ছে এ দেশে। মানুষ ভীত হচ্ছে তাতে। প্রতিবাদী হচ্ছে না। অথচ রাজনীতি নয়, বর্তমানের এই সংস্কৃতি ধ্বংসের, প্রাণ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের সব থেকে বড় প্রতিবাদের মাধ্যম হতে পারত সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে। আজ যদি যে কোন সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শাহবাগে সন্ত্রাস, অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কনসার্ট হতো, লাখ লাখ তরুণ জড়ো হতো যদি সেই কনসার্টে, মুহূর্তে বদলে যেত দেশ। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমাদের সেদিনের ছেলেরা ফুটবল খেলেছে। এখন কেন জেলায় জেলায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, অন্ধত্বের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলবে না! সাংস্কৃতিক জোটগুলো দিন দিন ক্ষীণকায় হয়ে যাচ্ছে, কারণ তারা পেশী ও গোষ্ঠী স্বার্থের রাজনীতির অনুগত বেশি। তারা প্রজন্মের কম্পনকে ধরতে পারছে না। আটকে আছে ষাটের দশকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সন্ত্রাসের মধ্যে একটি জাতি বাঁচতে পারে না। জাতিকে বাঁচতে হলে, সমাজকে বাড়তে হলে তার অনেক সঙ্গীর প্রয়োজন পড়ে। এই সঙ্গীগুলো আসে সাংস্কৃতিক জগত থেকে, যা শুধু মনোজগতের অন্ধত্ব দূর করে না, মানুষের বাঁচার সঙ্গী হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ এখন যে সাংস্কৃতিক সঙ্কটে পড়েছে একে কাটিয়ে উঠে তাকে বাঁচার জন্য অনেক সঙ্গী তৈরি করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে, কেন এবং কী জন্য দেশে এই সন্ত্রাসের পরিবেশ বেশি করে তৈরি করা হচ্ছে তা নিশ্চয়ই সচেতন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনীতি ও প্রশাসন আছে ঠিকই তবে তার আগে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোকে প্রতিরোধে নেমে আসা। তারা যদি সাড়া জাগাতে পারে- ঠিকই আলো জ্বলে উঠবে, অন্ধকার পালাবে। [email protected]
×