নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত দিতেই বেশি পছন্দ করি। চারদিকে অনৈতিক কর্মকা-ের ছড়াছড়ি, মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং দায়িত্ব-কর্তব্যনিষ্ঠার বিরাট অভাব- এসব কারণেই স্বাভাবিকভাবে নেতিবাচক উদাহরণ সামনে চলে আসে। তাই এর বিপরীত চিত্র পেলে আমরা চমকিত হই। সেসব সংবাদ শিরোনামও হয়। আমরা হাঁপ ছেড়ে বলি, শাবাশ! এমনটাই তো হওয়ার কথা। আমরা যে মানুষ! আমাদের কাজ হবে তাই মানুষের মতো। মনুষ্যত্ব রয়েছে বলেই একজন দরিদ্র অটোরিক্সাচালক ভুলবশত তার যাত্রীর ফেলে যাওয়া বড় অঙ্কের টাকা বা দামী অলঙ্কার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আইনের সাহায্য প্রত্যাশী হন। ওই অর্থ বা সম্পদে তার নিজের অধিকার আছে বলে মনে করেন না। অথচ আমাদের সমাজে অন্যের অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার সংস্কৃতি বড় হয়ে উঠেছে। তবে আশার জায়গাটি হলো, সততা পুরোপুরি নির্বাসিত হয়নি। সততার মূল্য একজন অসৎও বোঝে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে।
সম্প্রতি নিজ জঙ্গীপুত্রকে আইনের হাতে তুলে দিয়েছেন এক বঙ্গজননী। অতিরিক্ত আবেগময়তার জন্য সুনাম রয়েছে বাঙালী মায়ের। সন্তানের দোষ তার নজরেই পড়ে নাÑ এমন ‘সুখ্যাতি’ও আছে তার। নিজ সন্তান অপরাধী জেনেও তাকে আড়াল করার কিংবা নিরাপদে পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেয়ার কাজটি করতেও মা পিছপা হন না। এমন উদাহরণ দেয়ার জন্য আমাদের বেশি দূর যেতে হবে না। এই তো সেদিন এক সাংসদ মায়ের ‘সুপুত্র’ গভীর রাতে মদ্যপ অবস্থায় যানজটে বিরক্ত হয়ে গুলি ছুড়েছিল। তাতে নিহত হন নিরীহ ব্যক্তি। অবশ্য দেশে ‘কুলাঙ্গার পুত্রের’ তালিকা করতে গেলে প্রথমেই একজনের মুখ ভেসে ওঠে। জোট সরকারের আমলে মহাক্ষমতাধর মা-টির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিপুল উত্থান ঘটেছিল। তার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল দেশবাসী। পরবর্তীকালে গুণধর পুত্রটির বিচিত্র অপরাধের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। এজন্য মায়ের সামান্য অনুশোচনা দেশবাসী কিন্তু প্রত্যক্ষ করেনি। যাহোক, ঈশ্বরদীতে গির্জার যাজক লুক সরকার হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় পুত্র রাকিবুল ইসলামকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে তার পরিবার। ছেলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় বিস্মিত-ব্যথিত মা আজমিরা খাতুন ওই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন।
বিশ্বের সব পিতা-মাতাই সন্তানকে ভালবাসেন। অপত্য স্নেহের ছায়ার নিচে তাদের আগলে রাখতে চান। সন্তানের মুখ চেয়েই ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তানের চাহিদা যথাসাধ্য মেটাতে অভিভাবকের পরিশ্রমের শেষ থাকে না। সন্তানের মুখে হাসি দেখার প্রত্যাশাতেই তাদের যত পরিশ্রম। সন্তান জন্ম দেয়া সহজ। কিন্তু সফল ও যোগ্য পিতা-মাতা হওয়া কঠিন। সন্তান মানুষ করা কঠিন। পিতা-মাতার কাছে সন্তান অমূল্য সম্পদ। তাদের ঘিরেই থাকে সব স্বপ্ন। অথচ সফল পিতা-মাতা কি করে হ’তে হয় অধিকাংশ মানুষই তা জানেন না বা জানলেও অনুসরণ করেন না। ফলে সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, সন্তানরা বিপথগামী হয়। ঈশ্বরদীর ওই ন্যায়নিষ্ঠ এবং সন্তানের প্রকৃত মঙ্গলাকাক্সক্ষী জননী আমাদের সমাজে এক অনুসরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ থেকে প্রতিটি অভিভাবকেরই শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে সাহায্য করা যে অপরাধীর নিকটাত্মীয়ের একটি নৈতিক দায়িত্বÑ এ কথাটি স্মরণে রাখলে সমাজ তথা দেশেরই কল্যাণ। জঙ্গীবাদের মতো গুরুতর অপরাধ নির্মূলে আমাদের সবারই ভূমিকা রাখতে হবে।