ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীপনকে শেষ বিদায়

পরীক্ষা শেষে বাবার জানাজায় ছেলে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২ নভেম্বর ২০১৫

পরীক্ষা শেষে বাবার জানাজায় ছেলে

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ কিশোর রিদাদ ফারহান পরীক্ষা দিতে যেতে চাইছিল না। কিন্তু শিক্ষা এ পরিবারের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলেই হয়ত বুকে পাথর বেঁধে সকালে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হয় রিদাদকে। সকালে মা রিদাদকে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে দেন। যখন ছেলেটি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা দিতে গেল, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে শুয়ে ওর বাবা ফয়সল আরেফিন দীপন। পরীক্ষা শেষে রবিবার দুপুর ১টার দিকে ওকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। সেখানেই প্রাণাধিক প্রিয় বাবার জানাজায় অংশ নেয় নিহত দীপনের একমাত্র ছেলে রিদাদ। পরে সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাবাকে শেষ বিদায় জানায় রিদাদ। গতকাল রবিবার দুপুর ২টা ৪২ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। এ সময় তার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও লেখক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজিবীসহ নানা স্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে রবিবার সকালে রিদাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসাজুড়ে শোকের ছায়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য নির্মিত কবি সুফিয়া কামাল হলসংলগ্ন আবাসিক শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের বাসভবন। ভবনটির নাম ‘প্রফুল্ল’। সামনের বাগানে ফুটে আছে রংবেরঙের ফুল। ছিমছাম, সাজানো-গোছানো এ ভবনে যেন প্রফুল্লের আবহ একদমই ছিল না। ছিল শুধু বেদনার ছায়া, কান্নার সুর। দীপনের স্ত্রী ডাঃ রাজিয়া রহমান জলি বুকের ভেতর পাথর চেপে দাঁড়িয়ে থাকেন মরদেহের সামনেই। পাশেই দীপনের মুখে হাত বোলাচ্ছেন বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। চারদিকের বোবা কান্নাকে স্তব্ধ করে দিয়ে দীপনের স্ত্রী বললেন, ‘আসুন, একটু দোয়া পড়ি। আল্লাহ যেন তাঁর (দীপন) সব গুনাহ আমাকে দিয়ে দেন। ফেরেশতার মতো মানুষ ছিলেন তিনি।’ মোনাজাত শেষে দু’হাতে স্বামীর মুখটি স্পর্শ করে কাঁদো কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘খুব কষ্ট লাগছে তোমার, তাই না?’ পাশে জড়ো হয়ে থাকা অন্য স্বজনদের কণ্ঠে তখন কান্নার সুর। ডাঃ রাজিয়ার রহমান জলির কণ্ঠে স্বজনদের কষ্ট যেন আরও বেড়ে যায়। ঘিরে থাকা স্বজনরা আরও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। পাশে চেয়ারে বসে একদমই চুপ দীপনের মা রোকেয়া প্রধান। কোন শব্দ করছেন না। যেন ছেলে ঘুমাচ্ছেন, তাঁকে ডাকা যাবে না, শব্দ করলেই ঘুম ভেঙ্গে যাবে, ছেলের খুব কষ্ট হবে। দীপনের আদরের ছোট্ট মেয়ে রিদমা। মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ‘বাবা নেই’Ñ এটা বিশ্বাস করতে হয়ত সময় লাগবে ওর। বাবার নিথর দেহটির সামনে বসে চোখের পানিটুকু মুছে নিচ্ছিল সে। পরিবার-স্বজনদের শেষ দেখার পর ফয়সল আরেফিন দীপনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে। এর আগে গতকাল দুপুর পৌনে ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজায় হাজারো মানুষ অংশ নেয়। জানাজায় নিহত দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাবির ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিয়া রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও প্রকাশক মফিদুল হক, নিহত দীপনের শ্বশুর ডাঃ জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। এ ছাড়াও জানাজায় অংশ নেন বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার প্রধানরাও। এ সময় দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক স্মৃতিচারণ করে বলেন, সবসময় সবার উপকার করতে চেয়েছে দীপন। কখনও কারও সঙ্গে তা কোন শত্রুতা আছে বলে আমার জানা নেই। সে সবসময় সৎ পথে থাকতে চেয়েছে। কোন মতে চলার জন্য সে প্রকাশনা সংস্থাটির সঙ্গে ছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, আমি মামলা করতে চাই না। তবুও প্রক্টরের অনুরোধের কারণে মামলা করব। কিন্তু আমি জানি বিচার পাব না। এর আগে অনেক ঘটনার তো বিচার চাওয়া হয়েছে, কিন্তু সে সবের কোন সুরাহা হয়নি। তাই বিচার চাওয়ার বিষয়ে কোন আস্থা আমার নেই। বন্ধুত্বের সূত্রে অভিজিত তাঁর বই প্রকাশ করতে দীপনকে দিয়েছিল। আর সে কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। দীপনের জন্য বন্ধুদের মানববন্ধন ॥ ঢাকা কলেজের ১৯৯১ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দীপন হত্যার বিচার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনের সড়কে একটি মানববন্ধন করে দীপনের বন্ধুরা। দীপনের ব্যাচমেটদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘বন্ধু হত্যার বিচার চাই। পরে দীপনরা বন্ধুরা ‘দীপন হত্যার বিচার চাই’ লেখা কালোব্যাজ ধারণ জানাজায় অংশ নেন। প্রসঙ্গত, গত শনিবার রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এদিন আরও তিনজন প্রকাশক ও ব্লগারকে কুপিয়ে আহত করা হয়। আগামী শুক্রবার বাদ আছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে দীপনের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।
×