শংকর কুমার দে ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে খুন করার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার লেখক খুনের তালিকায় আরও একজন যুক্ত হয়ে খুনের তালিকা দীর্ঘায়িত করেছে জঙ্গী গোষ্ঠী। দেশে গত ৩ বছরে খুন হয়েছেন ১১ প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার। আরও ৮৪ প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার আছেন হিটলিস্টে। তারা একের পর এক খুন হলেও চিহ্নিত হচ্ছে না নির্দেশদাতারা। এখনও পর্যন্ত এসব হত্যার কোনটিরই বিচারও হয়নি। প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৬ জন আটক ও গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই খুনের ঘটনার কথা স্বীকার করেনি। যারা খুনের ঘটনায় আটক বা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছে। এমনকি জামিন নিয়ে বের হয়ে আবারও খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন এমন নজিরও আছে। প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার একের পর এক খুনের ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন। একের পর এক প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুনের ঘটনা বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়ভারে অভিযুক্ত হচ্ছে। এতে স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, রাজনীতিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দুপুরে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে নিহত অভিজিত রায়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশকসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করার কয়েক ঘণ্টার মাথায় অভিজিত রায়ের বইয়ের আরেক প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে জঙ্গীরা। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার হত্যাকা-ের প্রকৃত খুনিদের ও তাদের নির্দেশদাতা পরিকল্পনা-কারীদের চিহ্নিতকরণ, গ্রেফতার, খুন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। নিহত প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগারদের আগে থেকেই হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল এবং যারা নিহত হয়েছেন তাদের অনেকেই নিরাপত্তা চেয়ে থানা পুলিশে জিডি করেছেন। তারপরও একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছেই।
২০১৩ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওনলাইন ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ৮৪ জনের একটি তালিকা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। এই তালিকায় থাকা ব্লগার ও নতুন সহযোগীদেরই হিটলিস্টে রেখেছে উগ্রপন্থীরা। রাজধানীর উত্তর গোড়ানে খুন হওয়া ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হেফাজত ইসলামের দেয়া ৮৪ ব্লগারের তালিকায় ৮০ নম্বরে নাম ছিল। গত ৭ আগস্ট নীলাদ্রি হত্যার পর আনসাররুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সাদ আল নাহিন, মাসুদ রানা, কাউসার হোসেন ও কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা এর আগে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে ছিল। গ্রেফতারকৃতরা হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়ার কথা অস্বীকার করেছে। তবে তারা এই হত্যা সমর্থন করে বলে জানিয়েছে। তাদের কাছে পাওয়া কিছু তথ্যের সূত্র ধরে খুনীদের শনাক্ত করা চেষ্টা চলছে।
গত ৩ বছরে যে ১১ প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুন হন তার মধ্যে গত ৩০ মার্চ বেগুনবাড়িতে দিনের বেলায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর পালানোর সময় এক হিজড়া জাপটে ধরে আটক করে জিকরুল্লাহ ওরফে জিকির (২০) ও আরিফুর রহমান (১৯) নামে দুজনকে। আটককৃতরা মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের একজন চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। অপরজন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও নির্দেশদাতা চিহ্নিত করা যায়নি। এমনকি খুনের সময়ে যারা সরাসরি জড়িত ছিল তাদের নাম বলার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুনীদের গ্রেফতার করতে পারেনি।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে টিএসসিতে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়কে (৪০) একই কায়দায় দুজন কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা (৩০)। বন্যার বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি খুনীদের চাপাতির কোপে কেটে পড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় সেদেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) একটি দল ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে এসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করে। এখন পর্যন্ত এ হত্যার তদন্তের ফল শূন্যই বলা যায়। অভিজিত রায় হত্যা হত্যাকা-ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ফারাবীকে। ফারাবীর বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা ডিবির আদালতে রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ফারাবীর ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো যাচাই-বাছাই এবং অপরাধে তার সংশ্লিষ্টতা কতটুকু- তা খতিয়ে দেখতে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সে আগেই অভিজিতকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন উল্লেখ করেন আদালতে। পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী কমিশনার মিরাশ উদ্দিন আদালতকে বলেন, ‘উগ্রপন্থী সংগঠনের নেতা হত্যা মামলার আসামি জামিনে মুক্তি পেলে সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তদন্তে বিঘœ ঘটাতে পারে। আবারও নৃশংস হত্যাকা- ঘটাতে পারে।’ ডিবি পুলিশ ফারাবীকে নিয়ে তার ‘সমমনা উগ্র ব্লগারদের’ ধরতে অভিযানে যেতে চায় বলেও আদালতকে জানানো হয়। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়েও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ফারাবী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ফারাবীকে ওই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। ফেসবুক ব্যবহার করে জানাজা পড়ানোর ইমামকে হত্যার হুমকি দেয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ‘১৩ সালের জুনে ঢাকার একটি আদালত অভিযোগও গঠন করে তার বিরুদ্ধে। হাইকোর্টের জামিনে ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান ফারাবী।
ফারাবী মুক্তি পেয়েই ‘নাস্তিকদের’ হত্যাকা-ের বিষয়ে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে, পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হলেও ২০১০ সালে হিযবুত তাহরীরে সক্রিয় হয়ে লেখাপড়া শেষ করেননি তিনি। নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে একমাস জেলও খাটতে হয়েছিল ফারাবীকে,্ এখন আবার অভিজিত রায় হত্যায় গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী।
গত ১২ মে সকালে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মামলাটির তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বলেন, হত্যায় জড়িত সন্দেহে মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে হত্যায় তিনজনের সম্পৃক্ততা ছিল। তারা দুজন ছাত্র মজলিস ও একজন ছাত্রশিবিরের সদস্য। এ ঘটনায় জড়িত আরও তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতার করতে না পারায় চার্জশীট দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে কুপিয়ে ও জবাই করে রাজধানীর পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুনের ঘটনা। এই খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। খুনের মামলার প্রধান আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা এখনও পলাতক। অন্য আসামিরা হচ্ছেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস বিভাগের বহিষ্কৃত ছাত্র সাদমান ইয়াছির মাহমুদ, ফয়সাল বিন নাঈম দীপ, এহসান রেজা রুম্মান, মাকসুদুল হাসান অনিক, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজ এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মোঃ জসীমুদ্দিন রাহমানী। এ মামলায় একমাত্র মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানী ব্যতীত অন্য আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
গত শনিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম এবং কয়েক ঘণ্টার মাথায় শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে অভিজিত রায়ের বইয়ের আরেক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারীর একই চক্রের বলে আইনশৃংখলা বাহিনীর তদন্তকারীদের ধারণা। আঘাতের চিহ্নও একই ধরনের। দুটি স্থানেই কুপিয়ে হতাহত করার পর ঘর তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। ধারণা করা হয়, এ দুটি হামলায় অংশ নিয়েছে একাধিক গ্রুপ। তবে চিকিৎসক, পুলিশ ও গোয়েন্দারা এমন তথ্য দিলেও মধ্যরাত পর্যন্ত হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়নি। খুনীরা এখনও আটক হয়নি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রথম প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুন হলে তালিকায় থাকা অন্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ হয় সরকার। তখন সিদ্ধান্ত হয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার। পরে পুলিশের বিশেষ শাখার গোয়েন্দারা প্রায় এক মাস ব্লগারদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, পারিবারিক অবস্থানসহ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। বলা হয়, তালিকাভুক্ত অনেকেরই আগ্নেয়াস্ত্র কেনার ক্ষমতা নেই। এর পরই ব্লগারদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়াটি ঝুলে যায়।
গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও ডিবির কর্মকর্তাদের কাছে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুনের খুনী ও তাদের নির্দেশদাতারা কেন গ্রেফতার হচ্ছে না বা আড়ালে থেকে যাচ্ছে সেই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে সিøপার সেল এ ধরনের হত্যা কার্যক্রম চালাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের মদতে জেএমবি, হুজি, হিযবুত, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে শতাধিক স্লিপার সেল গঠন করে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার খুনে সক্রিয়। দেশী জঙ্গী সংগঠনের সিøপার সেলের সদস্যরা আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর আদলে ‘কাট অফ’ বা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে একের পর এক ব্লগার ও প্রগতিশীল লেখক খুন করে যাচ্ছে। হত্যাকারীরা একে অপরকে না চেনার কারণে এবং মোবাইল ফোনের প্রযুক্তির বদলে অনলাইনভিত্তিক সুরক্ষিত ব্যবস্থায় যোগাযোগ মাধ্যম গড়ে তোলার কারণে খুনী ও তাদের নির্দেশদাতা পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।