ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কালো গিলে খাচ্ছে সব আলো

ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান...

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ নভেম্বর ২০১৫

ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান...

মোরসালিন মিজান বর্ষা গত হয়েছে। বৃষ্টি আর নেই। তবু বাংলার মাটি ভেজা। লাল রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে সবুজ। কালোয় হারাচ্ছে। বহুদিন ধরে হা করে থাকা অন্ধকার গিলে খাচ্ছে সব আলো। চিন্তা গিলে খাচ্ছে। স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে নেই। বাঁচতে দেয়া হচ্ছে না। এক একটি খুন, এক একটি পরাজয়ের ক্ষত। মানবিক সমাজ মার খাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এই কী পাওয়া হলো? উত্তর নেই। দীর্ঘশ্বাস বড় হচ্ছে, দীর্ঘ হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের হুমকির মুখে ছিল বাংলাদেশ। তবে একাত্তরের নৃশংস খুনী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে নানা রূপে চেহারায় সামনে আসছে। বিশেষ করে, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জেগে ওঠা শাহবাগ আতঙ্কে ফেলে দেয় বাংলাদেশ বিরোধীদের। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যে গণআন্দোলন, তাতে কালিমা লেপনের সব চেষ্টা করে তারা। কৌশলের অংশ হিসেবে জনসমুদ্র হতে ব্লগারদের আলাদা করে। এমনকি যারা ব্লগ লেখেন না তাদেরও ব্লগার নাম দিয়ে খুন করতে শুরু করে। প্রথম হত্যাকা-ের শিকার রাজিব নামের এক তরুণ ব্লগার। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। অভিযোগ যেহেতুÑ আইন আছে, বিচার তো হতে পারে। না, সে পথ তারা মাড়ালেন না। নৃশংসভাবে খুন করা হলো রাজিবকে। তখনও সেটি ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। উগ্রবাদীদের হঠাৎ আক্রমণ হিসেবেই ধরে নেয়া হয়েছিল। অথচ আজ একের পর এক খুনের ঘটনা। স্বপ্ন নেই, চির ঘুমের কাল এসে হাজির হয়েছে যেন। লেখার জবাব লেখায় পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তের রেখায় ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে বাংলাদেশের। সর্বশেষ শনিবারের নির্মম নিষ্ঠুর আক্রমণ দেখে হতভম্ব মানবিক মানুষ। এদিন নিজের অফিস কক্ষে কুপিয়ে খুন করা হয় যে তাজা প্রাণটিকেÑ তিনি একজন প্রকাশক। দীপন বই প্রকাশ করতেন। একই কারণে দুই লেখক কবিসহ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন আরেক প্রকাশক টুটুল। সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমেদকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। তাহলে কি সত্য হচ্ছে সেই শঙ্কা? ব্যক্তি নয়, মুক্ত মত ও চিন্তার স্বাধীনতা আক্রান্ত হচ্ছে? অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই কী মূল টার্গেট? পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চক্রান্ত? বিশ্লেষকরা তাই বলছেন। বহুদিন ধরে বলছেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের এমন পরাজয় মানতে পারছেন না দেশপ্রেমিক নাগরিকরা। বুকে তাদের ব্যথা বাড়ছে। ক্ষোভ জমছে। পঞ্জীভূত হচ্ছে। এমনকি দীপনের বাবার মন্তব্য খুব প্রণিধানযোগ্য। ছেলে হারানোর শোক বুকে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, লালমাটিয়ায় টুটুলদের ওপর যারা হামলা করেছে, তারাই হত্যা করেছে দীপনকে। একই রকম আক্রমণে খুন হওয়া অভিজিত দীপনের বন্ধু ছিল। ওর বই প্রকাশ করেছে। সে ধর্মের বিরুদ্ধে কখনও লেখেনি। কোন উস্কানিও দেয়নি। এরপর খুনীদের বিচার চাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সেখান থেকে সরে এসে তিনি বলেন, আমি কোন বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। অভিমানী উচ্চারণে ব্লগার আরিফ জেবতিক লিখেছেনÑ যদি চাপাতির কোপ খেয়ে অপঘাতে মরে যাই, আমার মৃত্যুর পরে যেন ছারপোকা মার্কা রাজনীতিবিদরা বিবৃতি না দেয়, তাদের পাতিতস্য নেতারা আর দলদাস চামুচরা যেন আমার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি না তুলে। মূর্খ সাংবাদিকরা যেন আমার ক্রন্দনরত মায়ের মুখে ক্যামেরা জুম না করে, আমার দিশেহারা স্ত্রী আর বোনের কাছে যেন প্রতিক্রিয়া জানতে না চায়। উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবীর দল যেন টিভিতে আমার নাম উচ্চারণ করে টকশো না করে। আমি চাই না শেষ যাত্রায় কোন কীটসম নপুংসকরা আমার ধারে কাছে ভিড়ুক। ... মাত্র চারজন সাহসী মানুষ আমার কফিনটি বয়ে নিয়ে যাক। দেশের কোন এক কোলেই আমার চারটি বোন খুব নীরবে আচলে চোখ মুছুক একবার। কোন এক পিতা, কোন এক মা কোথাও একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলুন। এর বেশিকিছু চাওয়ার নেই কখনই। আমি দীপন ভাইয়ের বাবার মতো বলব না ‘বিচার চাই না’, বরং বিচার বকেয়া থাকুক। মুক্তিযুদ্ধের হত্যার বিচার যদি হয়ে থাকে, কোন একদিন আমার খুনেরও বিচার করবে আমাদের উত্তরসূরীরা। আমাদের প্রজন্মের রক্তে যদি এই দেশ ধুয়ে দিয়ে যেতে হয়, আমরা ধুয়ে দিয়ে যাব। ...আমাদেরকে যে কেউ খুন করতে পারবে, কিন্তু কেউ আমাদের পরাজিত করতে পারবে না। রাজপথে প্রতিবাদও চলছে। কবি নজরুল থেকে বললেÑ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ-/ ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত।/ কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত,/ এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার...। এমন ভাবনা থেকেই রবিবার ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে জঙ্গী হামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চসহ কবি লেখক প্রকাশকরা প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন। এসব সমাবেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষকে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও চলছে প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদী গণসঙ্গীত আজও প্রাসঙ্গিক। যেখানে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে বলা হচ্ছেÑ এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল/ কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই/ মুক্ত প্রাণের সাড়া আনবোই/ আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে/ নতুন সূর্যশিখা জ্বলবেই/ জ্বলবেই জ্বলবেই জ্বলবেই...। হ্যাঁ, সেই জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষা এখন। বহুকাল বুকে পঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে শেষবারের মতো জ্বলে ওঠা জরুরী। তবেই রক্ষা পাবে প্রিয় দেশমাতা। সবার, সকল মত পথের হয়ে ওঠবে সোনার বাংলা।
×