ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহুরীরচর বিনিময়ে ত্রিপুরাকে রাজি করতে দিল্লীর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ নভেম্বর ২০১৫

মুহুরীরচর বিনিময়ে ত্রিপুরাকে রাজি করতে দিল্লীর  উদ্যোগ

তৌহিদুর রহমান ॥ স্থলসীমান্ত চুক্তির আওতায় ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে মুহুরীর চর বিনিময়ের লক্ষ্যে দিল্লী ও ত্রিপুরার মধ্যে আলোচনা চলছে। মুহুরীর চর বিনিময়ে ত্রিপুরা আপত্তি তোলায় এ বিষয়ে ত্রিপুরা সরকারকে রাজি করাতে উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লী। এ নিয়ে ত্রিপুরা ও দিল্লীর মধ্যে সমঝোতার অপেক্ষায় রয়েছে ঢাকা। ঢাকা ও দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে মুহুরীর চর বিনিময়ে এখন আপত্তি তুলেছে ত্রিপুরা। সে কারণে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি পাঠিয়ে দ্রুত সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইতোমধ্যেই ত্রিপুরা রাজ্য সরকার থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রথমে দিল্লী তাদের ওই প্রস্তাবে সাড়া না দিলেও এখন সাড়া দিয়েছে। ত্রিপুরাকে পাশে রেখেই মুহুরীর চর সমস্যার সমাধান করতে চাইছে দিল্লী। ত্রিপুরার রাজস্বমন্ত্রী বাদল চৌধুরী বলেছেন, দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া শহরের পাশে মুহুরীর চর বিনিময় নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে এই সমস্যা দ্রুত মেটাতে চাইছে রাজ্য সরকার। ত্রিপুরা রাজ্যের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও তাদের না জানিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বিলোনিয়া শহর-লাগোয়া মুহুরীর চরে সীমানা চিহ্নিত করেছেন বলে অভিযোগ করেছে ত্রিপুরা। সূত্র জানায়, ২০১১ সালের প্রোটোকল অনুযায়ী, বিলোনিয়ায় মুহুরী নদীর মাঝ বরাবর আন্তর্জাতিক সীমান্ত তৈরি হওয়ার কথা। এই প্রোটোকল বাস্তবায়ন করতে হলে বিলোনিয়া সীমান্তের ৩৬ একর জমিও বাংলাদেশ পাবে। এছাড়া ব্যক্তিগত মালিকানার প্রায় ১৫ একর জমিও বাংলাদেশ পাবে। জমির মালিকরা জমি দিতে রাজিও হয়েছেন। তবে ত্রিপুরা তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৪০ কোটি রূপী ক্ষতিপূরণ চেয়েছে। এ নিয়ে এখন দিল্লী ও ত্রিপুরার মধ্যে আলোচনা চলছে। মূলত কেন্দ্রীয় সরকার এই অর্থ দিলে কোন সমস্যাই থাকবে না বলে জানিয়েছে ত্রিপুরা। আর ত্রিপুরা-দিল্লীর মধ্যে সমঝোতার অপেক্ষায় রয়েছে ঢাকা। ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে মুহুরী নদীর সীমানা নির্ধারণ ছাড়াই বাংলাদেশ ও ভারতের নতুন মানচিত্রের নক্সা চূড়ান্ত হয়। সে সময় নতুন করে মুহুরী নদীর সীমানা জরিপ দাবি করে ভারত। তবে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই মুহুরী নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে চাইছে বাংলাদেশ। ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের পর জুলাই মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে দুই দেশের মানচিত্রের নক্সা চূড়ান্ত করা হয়। এই মানচিত্র অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তে নতুন করে সীমানা চিহ্নিত হয়। এ সময় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত এলাকার ৩১টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ৩০টি ম্যাপই সই হয়েছে। তবে একটি স্ট্রিপ ম্যাপ সই হয়নি। আর সেটি হলো বিলোনিয়া সীমান্তের মুহুরী নদীর সীমানা সংক্রান্ত স্ট্রিপ ম্যাপ। বিলোনিয়া সীমান্তে মুহুরী নদীর সীমানা নিয়ে বিতর্ক ওঠার কারণে এই ম্যাপে সই হয়নি। ভারতীয় কর্র্তৃপক্ষ মুহুরী নদীর সীমানা নিয়ে নতুন করে জরিপ দাবি করে। তবে ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যৌথভাবে যে সীমানা জরিপ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করা হোক। তবে বাংলাদেশের এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি ভারত। তারা নতুন করে মুহুরী নদীর সীমানা জরিপ দাবি করে। সে কারণে এই স্ট্রিপ ম্যাপটিতে আর সই হয়নি। সূত্র জানায়, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা নির্ধারণসহ প্রায় সকল বিষয়ে দুই দেশ এক মত হলেও বিলোনিয়া সীমান্তে মুহুরী নদীর সীমানা নিয়ে ঐকমত্য সম্ভব হয়নি। তবে দুই দেশ এরপর থেকে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে চাইছে। আর এরই মধ্যে ওই জমি বিনিময় নিয়ে আপত্তি তোলে ত্রিপুরা। মুহরী নদী ভারতের ত্রিপুরার লুসাই পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমে ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে চট্টগ্রাম এবং ফেনী জেলাকে পৃথক করেছে। মুহুরী বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে কাজ করে। তবে ঘনঘন প্রবাহ পথ পরিবর্তনের জন্য এই নদী দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল বহু বছর। বিবাদমান এই নদীর সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয়দেশ ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির ভিত্তিতে নদীর প্রবাহে সীমানা নির্ধারণের পক্ষে একমত পোষণ করে। বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের সীমান্ত নির্ধারণী পিলারের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ৪৭ একর জমির মালিকানা লাভ করে। তবে মুহুরী নদীর ওপর জেগে ওঠা ১৪৪ একর মুহুরীর চরের ধান চাষের উপযোগী ফসলি জমির মালিকানার জন্যই দীর্ঘদিন উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। সর্বশেষ ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরে এই সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সেই সময় উভয় দেশ সীমান্ত চিহ্নিতকরণে সম্মত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত ৬ জুন ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময় হয়। মোদির সফরের মধ্য দিয়ে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সে অনুযায়ী গত ২৩-২৪ জুলাই ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দুই দেশের সীমানার নতুন মানচিত্রের নক্সা চূড়ান্ত হলেও শুধু বিলোনিয়া সীমান্তের মুহুরী নদীর সীমানা নির্ধারণ সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার মুহুরীর চর সীমান্তের জমি বিনিময়ে আপত্তি তোলে। এখন ত্রিপুরাকে রাজি করিয়ে এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লী।
×