ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রী বিক্রি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২ নভেম্বর ২০১৫

অভিমত ॥ কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রী বিক্রি

ছবিটি ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস থেকে নেয়া। ঢাকার রামপুরা এলাকার একটি কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন এটি। যেখানে বলা আছে ‘একটি স্বনামধন্য রানিং কোচিং সেন্টার স্টুডেন্টসহ বিক্রি হবে।’ দুটো জিনিস এখানে পরিষ্কার। এক. বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকেই এই কোচিংয়ের মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দুই. কোচিং সেন্টারগুলো তাদের স্টুডেন্টদের বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবেই গণ্য করে। তাই যখন মালিকানা বদল হয় তখন তারা ছাত্রছাত্রীর মাথা প্রতিও দাম ধরে। খাদ্যে ফরমালিন মিশিয়ে এদেশের এক শ্রেণীর নরপশু খাদ্য ব্যবসায়ীরা যেমন একটি জাতিকে স্নো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক তেমনি একটি জাতির ছাত্রছাত্রীর বড় অংশকে কোচিংয়ের নামে পঙ্গু বানিয়ে জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলো। দম বন্ধ পরিবেশে এক রুমে গাদাগাদি করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের তোতাপাখির মতো পড়া গিলতে বাধ্য করা হয়, পাশাপাশি কোচিং ব্যবসায়ীদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের আপ্রাণ চেষ্টা তো থাকেই। কোমলমতি শিশুদের মননের, মেধা বিকাশের বারোটা। শিশু কি শিখল, না শিখল কিচ্ছু যায় আসে না। ‘এ+’ একটা পেলেই হলো। সরলমনা বাবা-মা খুশি, কোচিংয়ের ব্যবসার আরও পোয়াবারো। কিন্তু এর প্রথম ধাক্কাটা লেগেছে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়। ৪০ হাজারে ১৭ জন মাত্র ইংরেজীতে পাস! এ বছরের অবস্থাও ভাল না। গত মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৫ শতাংশের কম ছাত্রছাত্রী পাস করেছে। এই বিপর্যয়ের অন্যতম বড় কারণ কোচিং সেন্টার। টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া ইউনিয়নে আমি শিক্ষা নিয়ে গত ছয় বছর ধরে কাজ করছি। গ্রাম ছেড়ে যাবার ২২ বছর পর আবার গ্রামে ফিরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অবাক ও হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম গ্রামের শিক্ষার বড় অংশই অবৈধ কোচিং সেন্টারের পকেটে। আমি এই গ্রামের ছেলে। এখানকার সরকারী প্রাইমারী স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি। এখান থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করে কোনরকম কোচিং ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছি। স্কলারশিপ নিয়ে দু’বার ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েছি, আমেরিকায় টিচার্স সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি। নিজের ঢোল নিজে পেটালাম এই জন্য যে, সেই ’৭০-’৮০-এর দশকের গ্রামের প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল যদি আমাদের মতো ছাত্র তৈরি করতে পারে তো এখন কি গ্রামের সেই স্কুলগুলোর মান কমে গেছে? মোটেই তা নয়, বরং বেড়েছে আমি মনে করি, কারণ সরকারী টিচাররা এখন নানারকম ট্রেইনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ক্লাসরুম ম্যানেজমেন্ট, চাইল্ড সাইকোলজি ইত্যাদি বিষয়ে তারা এখন আরও বেশি জানেন। এছাড়াও চমৎকার খেলার মাঠ নিয়ে আরও বড় পরিসরে আমার সেই প্রাইমারী স্কুল এখন আরও সমৃদ্ধ। কিন্তু সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম। সব গিয়ে কোচিং সেন্টারের ফাঁদে। ছাত্রছাত্রীর একটা বড় অংশ প্রাইমারী স্কুলে নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে রাখে কিন্তু সারাবছর তোতাপাখির মতো পড়া মুখস্থ করে কোচিং সেন্টারের দমবন্ধ পরিবেশে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কোচিংগুলোর কি ব্যবসা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। অথচ, এক টাকাও তারা সরকারকে ট্যাক্স দেয় না। কারণ, সরকার কর্তৃক যে ব্যবসা অবৈধ তার আবার ট্যাক্স কি? কে পড়াচ্ছে, কি পড়াচ্ছে, শিক্ষকের মান কি, যোগ্যতা আছে কিনা ইত্যাদি কিচ্ছু যায় আসে না। সারা গ্রাম তাদের নানারকম সাইনবোর্ডে ঢাকা। রমরমা ব্যবসা, রমরমা মার্কেটিং। মাঝখান দিয়ে কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যত শেষ! কোচিং সেন্টারগুলোর এই সর্বনাশা খেলা আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করে শাস্তির ব্যবস্থা নেই ততই দেশের জন্য মঙ্গল। শাস্তি হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। আমার মতে, খাদ্যে ফরমালিন মেশায় এমন এক ব্যবসায়ী আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত একজন কোচিং সেন্টার ব্যবসায়ী, এই দুই জগত থেকে ‘মাত্র দু’জনকে’ যদি দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে ফাঁসি দেয়া যেত তাহলে রাতারাতি শিক্ষায় এবং খাদ্যে একটা বড় পরিবর্তন চোখে পড়ত। প্রশ্ন হলো, এই মহতী এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো দেশে কি কেউ আছে? একজন আছে! আমরা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছি আশা নিয়ে। লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক ুরধযধংধহ৬৯@মসধরষ.পড়স জিয়া হাসান
×