ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কে. এম. এনায়েত হোসেন

জাতীয় চার নেতা আমাদের বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৩ নভেম্বর ২০১৫

জাতীয় চার নেতা আমাদের বাতিঘর

বাইবেলের জুডাস, পলাশীর মীর জাফর এবং বাংলার খন্দকার মোশতাকের মধ্যে একটি চমৎকার মিল লক্ষ্য করা যায়। জুডাস ছিলেন যিশু খ্রিস্টের একান্ত আস্থাভাজন বিশ্বস্ত বারোজন শিষ্যের একজন। তিনি যিশু খ্রিস্টের তহবিল রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন। মাত্র ত্রিশটি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে যিশুকে তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর শত্রুদের হাতে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করতে। পরে অনুতাপ আর অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেন আত্মহত্যা করে। মীর জাফর আলী খান নামমাত্র নবাবী লাভের আশায় ব্রিটিশ বেনিয়াদের সক্রিয় ইন্ধনে হত্যা করিয়েছিলেন মহৎপ্রাণ সিরাজউদ্দৌলাকে। বাংলার মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষকে তিনি বিকিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে। জাফরের উত্তরসূরি মোশতাকও বিশ্বাসঘাতকতা করে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একই বছরের ৩ নবেম্বর হত্যা করেন বাঙালী জাতির চার মহান নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম এইচ কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে। মূলত তার নির্দেশেই কতিপয় সেনাকর্মকর্তা মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে চালায় এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এর মাত্র তিন দিনের মাথায় ৮২ দিনের খলনায়ক মোশতাকের পতন ঘটে। জায়গা হয় কারান্তরালে। কিন্তু তার অপকর্মের সাক্ষাত বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান মোশতাকের বিচার না করে ১৯৭৮ সালে তাকে মুক্ত করে দেন এবং বিচারের পথ বন্ধে অবলম্বন করেন কূটকৌশলের। কিন্তু জনগণের ঘৃণা আর ধিক্কার থেকে তাকে রক্ষা করতে পারেননি জিয়াউর রহমান গং। ফলে তাকেও আমরণ অনেকটা বন্দী জীবনযাপন করতে হয় নিজ গৃহের অন্তরালে। দীর্ঘ একুশ বছর পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে জাতির গর্ব এই চার নেতার হত্যার বিচারকার্য শুরু করেন। যদিও ইতোপূর্বে ঘটনার পরপরই ৪ নবেম্বর, ১৯৭৫ সালে জেল হত্যাকা-ের বিষয়ে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি প্রদান করে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমকে স্থগিত করে দেয়। পরবর্তী সময় দীর্ঘ বিচারিক জট এবং ২০০১ সালে মোশতাকপন্থী বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণ আবারও বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। অবশেষে ২০০৪ সালে বিচারিক আদালত অভিযুক্তদের মধ্যে তিন জনকে মৃত্যুদ-াদেশ, বারো জনকে যাবজ্জীবন এবং পাঁচ জনকে খালাস দিয়ে রায় প্রদান করে। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট তারিখে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মেজর (অব) বজলুল হুদাসহ ছয়জনকে খালাস প্রদান করেন। হাইকোর্ট বিভাগ রিসালদার (অব) মুসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রাখেন। সরকার হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশনে পাঁচটি স্বতন্ত্র লিভ টু আপীল দরখাস্ত দাখিল করেন। ইতোমধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এই বিচারে জেল হত্যাকা-ের বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারও কারও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকরও হয়েছে। তবে অভিযুক্তদের অনেকেই আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আত্মগোপনে থেকে বিচার প্রক্রিয়াকে এড়াতে এবং নিজেদের বাংলাদেশবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছে। তাদেরই সক্রিয় সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকে চলমান ২০১৫ সাল অবধি এ দেশকে অস্থিতিশীল এবং সম্পূর্ণ অকার্যকর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তাদের এ দেশীয় দোসররা প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে পেট্রোলবোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা থেকে শুরু করে হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করেনি এবং করছে না। সর্বশেষ তারা মাত্র কিছুদিন আগে দুই বিদেশী নাগরিক ইতালির তাবেলা এবং জাপানের কোনিও হোশিকে হত্যাসহ শিয়া মতাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বোমাবাজি করে একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। আমরা আশা করতে পারি বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব ষোলো কোটি মানুষের জন্য বাংলাদেশকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলা; স্বল্প সংখ্যক সুবিধালোভী এবং সুবিধাভোগীরা যেন সে পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে না পারে কখনও, কোন অবস্থায়ই। জেলহত্যাসহ সকল বিচারের যেমন দ্রুত নিষ্পত্তি চাই, তেমনি দ্রুততার সঙ্গে চাই সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিনির্মাণে সময়োপযোগী সকল ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটাই আজকের সময়ের প্রধানতম দাবি। আর এ দাবি পূরণের প্রেরণা হোক সারাজীবন আদর্শিক রাজনীতির একনিষ্ঠ অনুসারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে আত্মদানকারী চার জাতীয় নেতা, আমাদের বাতিঘর! লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট
×