চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়কে হত্যার পর ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য ছিল দেশের তরুণ মুক্তচিন্তকদের পাশাপাশি তাদের গ্রন্থের দুই প্রকাশককে হত্যা করা। উভয় প্রকাশক মৃত্যুর হুমকি পেয়ে থানায় জিডিও করেন। শনিবার দিনদুপুরে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ওই দুই প্রকাশকের ওপর অভিন্ন নৃশংস কায়দায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এ দুজনের মধ্যে আহমেদুর রশীদ টুটুলকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হওয়ায় তার প্রাণরক্ষা পায়। অপর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে বাঁচানো যায়নি। এই জোড়া হামলা সুস্পষ্টভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপরই বর্বর আক্রমণ। এর ফলে সঙ্গত কারণেই দুটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। প্রথমত, মুক্তচিন্তার পক্ষশক্তি, সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখকবৃন্দ জীবনের ঝুঁকির মধ্যে আছেন। প্রকাশকরাও হুমকির বাইরে নন। দ্বিতীয়ত, হত্যাকারীরা সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত করলেও তারা প্রায় সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
মুক্ত চিন্তার পথ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে কূপম-ূক সমাজে। অথচ এমন পশ্চাৎপদ কা-জ্ঞানশূন্য সমাজে বেশি করে প্রয়োজন মুক্তচিন্তার মানুষ। চিন্তাকে মুক্তি দিতে অসমর্থ হলে আমরাও পাকিস্তান নামক একটি অসভ্য রাষ্ট্রের অংশ হয়েই থাকতাম। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জন তাই বৃহত্তর অর্থে মুক্তচিন্তারই সুন্দরতম ফসল। দুঃখের বিষয় হলো নানা বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার ভেতর দিয়ে বহুবিধ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সমাজ ক্রমশ এগিয়েছে অনুর্বর অনুদার প্রায় মুক্তচিন্তাহীন এক স্বার্থান্ধ প্রগাঢ় অন্ধকারের দিকে। সেখানে মুক্তচিন্তার বিপক্ষ শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা।
আমরা আগেও জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছি বাংলাদেশের ওপর মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ ছায়াবিস্তার করে চলেছে। তারা অন্ধকারের প্রাণী, আলোতে তাদের ভয়। যুক্তিবুদ্ধির ধার তারা ধারে না। তাদের কাছে মানবতন্ত্র নয়, বড় হলো চাপাতিতন্ত্র। লেখার জবাব যারা লেখায় নয়, চাপাতির মাধ্যমে দিয়ে থাকে, তারা রাষ্ট্রের আইন মানে না। তাই রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হয়ে তাদের অপতৎপরতা রোধ করতে হবে। শিকড়সুদ্ধ তাদের উপড়ে ফেলা চাই সভ্যতার স্বার্থে। যে কোন সমাজের সংস্কৃতি ও সভ্যতার উৎকর্ষের জন্য মননচর্চার বিকল্প নেই। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেকে সঙ্কুচিত ও নিয়ন্ত্রিত না ভাবলে তাতে যে সমাজ তথা মানব সভ্যতারই লাভ- সে কথা বলাই বাহুল্য। নৃশংসভাবে নিহত তরুণ প্রকাশকের শিক্ষক-পিতার ‘আমি বিচার চাই না’ উক্তিতে উহ্য অপরিসীম বেদনাবোধ ও চরম হতাশার দিকটি হৃদয়-গভীরে উপলব্ধি করা চাই। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে মানুষ দায়িত্বপূর্ণ কথা, আচরণ ও কাজ প্রত্যাশা করে। বার বার বিষয়টির ব্যতিক্রম ঘটা সরকারের জন্য যে বিব্রতকর সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয়া অপ্রয়োজনীয়। দেশবাসীর প্রত্যাশা, ফেব্রুয়ারির পর চাপাতির কোপে মোট পাঁচজন লেখক-প্রকাশকের মৃত্যুর নেপথ্যের খুনীচক্রকে এ বছরের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ধারাবাহিক মুক্তচিন্তক-হত্যা থামাতে না পারলে সেটা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অন্ধ অপশক্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মুক্তমত ডানা মেলতে অপারগ থাকলে হাজার বছরের পরম অর্জন স্বাধীনতার অর্থ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, যা আমাদের কারোরই প্রত্যাশিত নয়।
শীর্ষ সংবাদ: