ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভূমিদস্যুদের সঙ্গে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ

পাঁচ হাজার হেক্টর বন দখলে

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৪ নভেম্বর ২০১৫

পাঁচ হাজার হেক্টর বন দখলে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ উত্তর বনবিভাগের ৫ হাজার ৩৪১ হেক্টর বনভূমি অবৈধভাবে দখল করেছে ভূমিদস্যু লোকজন। জবর দখলকারীরা সরকারী বনে গড়ে তুলেছে পাকা-আধাপাকা বসতঘর, ইটভাঁটি, করাতকলসহ নানা স্থাপনা। এসব জায়গায় নগদ টাকায় বনভূমি কিনে রোহিঙ্গা অপরাধীরাও বসতি নির্মাণ করেছে। এতে করে সরকারী বনের বিরাট অংশ বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ওইসব ভূমি বনবিভাগের কিন্তু বিক্রি করছে ভূমিদস্যুরা। জবরদখলের বিষয়টি বনকর্মীরা দেখেও যেন দেখে না। জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন ৯টি রেঞ্জ ও ২৩টি বনবিটের নিয়ন্ত্রণে ৩৫.০০৬.৪৯ হেক্টর বনভূমি রয়েছে। এখানে সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ৫৭৯৫.৬৪ হেক্টর। এসব জমিতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে ৩০টি ইটভাঁটি, ৫৮টি অবৈধ করাতকল ও ৫০ হাজার অবৈধ বসতি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারী বনের ভেতর অবৈধ স্থাপনার কাজে বনজায়গিরদার ও বনবিভাগের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে সরকারী দলের পরিচয়ধারী কিছু ধান্ধাবাজ ব্যক্তি। এমনকি জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে ভূমিদস্যুরা নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে দলিলও করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। কক্সবাজার সদরের ফুলছড়ি রেঞ্জের অধীনে নাপিতখালী, জুমনগর এলাকায় স্থানীয় বনজায়গিরদারদের সহায়তায় এক হাজারের অধিক অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সৃজিত বনের ভেতরে নির্মিত হচ্ছে পাকা-আধাপাকা বসতঘর। তবে এসব বসতি গড়ে ওঠার পেছনে মোটা অঙ্কের টাকাও লেনদেন করার স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। যাতে স্থানীয় বিট কর্মকর্তা ও হেডম্যান-সহকারী হেডম্যান সরাসরি সম্পৃক্ত বলে এলাকাবাসী জানায়। স্থানীয় আব্দুল করিম নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ছৈয়দা বেগম নামে এক মহিলা বনের ভেতর সেমিপাকাঘর নির্মাণ করেছে। বাউন্ডারিওয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে বনভূমির বিরাট একটি অংশ। তার একাজে সহায়তা করছে ফুলছড়ি বনবিটের হেডম্যান আশরাফ আলী, সহকারী হেডম্যান আব্দুশ শুক্কুরসহ একটি সুবিধাভোগী চক্র। একইভাবে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তার অফিসের অতি নিকটে মালুমঘাট স্টেশনেও অবৈধভাবে বনভূমি দখলে নিয়ে দোকাপাট তৈরি ও মার্কেট বসানো হয়েছে। মালুমঘাট বাজারের উত্তর পাশে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বনাঞ্চলের বড় বড় গাছের ফাঁকে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার ঝুপড়ি-টিনের কাঁচা বসতঘর। জবর দখলের কবল থেকে ডুলাহাজারা বন বিটের কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশের মূল্যবান ও দৃষ্টিনন্দন বনাঞ্চলের জমিও বাদ যাচ্ছে না। এখানে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারদলের নামও ভাঙ্গানো হয়ে থাকে। এভাবে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের ডুলাহাজারা, রিংভং, নলবিলা, কাকারা, মানিকপুর বিটের বেশিরভাগ বনভূমি এখন বেদখল হয়ে গেছে। এখানে তৈরি করে নেয়া হয়েছে অবৈধ বসতি। দখলকারীদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ওসব বসতি স্থাপনের আগে বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হয়েছে। বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে মাসিক টাকা আদায় করে থাকে। যারা ঠিক মতো টাকা দেয় না, মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে শুধু তাদের ঘরগুলো উচ্ছেদ করা হয়। বনকর্মীরা টাকা পেলে সব ঠিক হয়ে যায়। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে রয়েছে খুটাখালী ন্যাশনাল পার্ক। এ পার্কে রয়েছে বিশাল আকৃতির শত বছরের কয়েক হাজার গর্জন গাছ। দৃষ্টি নন্দন এ গর্জন বাগানের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় দালান, বাউন্ডারি ওয়াল। এ যেন ধনী লোকজনের সাজানো গুছানো একটি বিশাল গ্রাম। এখানে বসবাসকারীদের বেশিরভাগ পরিবারই সচ্ছল। শুধু এখানকার বনভূমি মূল্যবান হয়ে উঠায় ভূমিদস্যুরা জবর দখল করে নিয়েছে সরকারী বনাঞ্চল। তবে এখানে বনপাহারায় নিয়োজিত স্থানীয় লোকরাও সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চকরিয়া বরইতলী বনবিটের বেশিরভাগ বনভূমিতেও নতুন নতুন ঘর উঠছে। ওই বন বিট অফিসের পাশের একটি এলাকা জুড়ে রয়েছে মাদার গর্জন বাগান। যা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী যে কারও দৃষ্টি খানিক আটকে দিতে পারে। ওই মাদার গর্জন গাছের ফাঁকে ফাঁকেও এখন ঘর তোলা হচ্ছে। এসব কর্মকা- হচ্ছে বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একেবারে নাকের ডগায়। এখানেও সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের কর্মকর্তা জানান, এক শ্রেণীর লোক সরকারী জমিতে রাতারাতি বসতি গড়ে তুলে। এ পর্যন্ত ৯৫০ হেক্টরেরও বেশি বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অবৈধদখলদারের বিরুদ্ধে আদালতে ৪ হাজার ৫২২টি পিওআর মামলা বিচারাধীন। রীট মামলা রয়েছে ১৭টি। অবৈধ বসতি উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
×