ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘যশোর রোড’ ফিরিয়ে এনে প্রতিবেদন চেয়েছে হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৪ নভেম্বর ২০১৫

‘যশোর রোড’ ফিরিয়ে এনে প্রতিবেদন চেয়েছে হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার॥ খুলনায় ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনতে আদালতের দেয়া নির্দেশনা সাত দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাইকোর্ট। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার বি কে শাহরিয়ার আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস। আদেশের পর ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, “কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী আদালতে বলেছেন, ২৭ অক্টোবর আগের আদেশের কপি পাওয়ায় তারা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে প্রতিবেদন দিতে পারেননি। আদালত তাকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন।” একইসঙ্গে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে সাত দিনের মধ্যে এই প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নাম প্রত্যাহার করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়েছে কি নাÑ এফিডেভিট আকারে তা জানাতে বলেছে আদালত। আগামী ৯ নবেম্বর বিষয়টি শুনানির জন্য আদালতের তালিকায় আসবে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবীকে ওই প্রতিবেদন দিতে হবে। ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক আরও বলেন, ঐতিহাসিক দুটি স্থাপনা থেকে চিহ্নিত রাজাকারের নাম পরিবর্তন করে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এর আগে কয়েকবার আদেশ দিলেও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ পাননি মর্মে আদালতে জানালে আদালত মঙ্গলবার পুনরায় সাত দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলেছেন। বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে আদালতের আদেশ তাদের কাছে পৌঁছানো হবে বলেও জানান তিনি। স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনা, সড়ক, অবকাঠামোর নামকরণ স্থগিত চেয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৪ মে রুলসহ খান-এ-সবুর ও শাহ আজিজুর রহমানের নাম ব্যবহার স্থগিতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয় হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের নামে থাকা সড়ক, স্থাপনা ও অবকাঠামোর নাম পরিবর্তনের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সে সবের নামকরণ কেন করা হবে না এবং যারা ওই নামকরণের জন্য দায়ী, তাদের কেন বিচারের আওতায় আনা হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। আদালতের ওই নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না জানিয়ে গত ২৫ অগাস্ট আরেকটি আবেদন করেন মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির। এরপর হাইকোর্ট যে আদেশ দেন, তাতে ‘খান-এ-সবুর’ সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ব্যবহার করতে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেইসঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নামও প্রত্যাহার করতে বলা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়িত না হওয়াতে ১ নবেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘সব খানে সবুর খানের ভক্ত?’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন রবিবার আদালতের নজরে আনেন আবেদনকারীপক্ষের ব্যারিস্টার আইনজীবী এ কে রাশেদুল হক । ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার পরও যুদ্ধাপরাধীদের নাম সরানোর কাজে দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী খান-এ-সবুরের ( সবুর খান ) নামে কোন স্থাপন থাকতে পারবে না বলে হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছে। আদেশের দুই মাস অতিবাহিত হলেও খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। কেসেসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা আদেশের কপি পাননি। সংবাদের আরও বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ১২ মে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও বিশিষ্ট ইতহাসবিদ, লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বাদী হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী খান-এ-সবুরের নাম খুলনার প্রধান সড়ক থেকে প্রত্যাহারের জন্য হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত সবুরের নাম স্থগিতের নির্দেশ প্রদান করেন। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে তৎকালীন সিটি মেয়র কোন উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান মেয়রও কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় বরেণ্য দুই ব্যক্তি পুনরায় হাইকোর্টে শরণাপন্ন হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট আদালত রায় প্রদান করেছেন। আদালতের দেয়া রায়ে খুলনা মহানগরীর খান-এ-সবুর সড়কের নাম প্রত্যাহার করতে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আজিজুর রহমান মিলনায়তনের নামও প্রত্যাহার করতে বলা হয়। দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও খুলনা সিটি কর্পোরেশন সবুর খানের নাম অপসারণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে রিটকারীর আইনজীবী রবিবার আদালতের বিষয়টি নজরে আনলে মঙ্গলবার আদালত সাত দিনের মধ্যে ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনার আদেশ দেন। মুসলিম লীগের নেতা খান-এ-সবুর পাকিস্তান আমলে ছিলেন আইয়ুব খানের মন্ত্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে বিচার শুরুর সময় প্রকাশিত ছয়শ’ স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীর তালিকাতেও তার নাম ছিল। সেই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের নামেই পরে যশোর রোডের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ থেকে কলকাতার দমদম পর্যন্ত এই সড়ক ধরেই একাত্তরে লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। তাদের দুর্দশা দেখেই আমেরিকান কবি এ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’, যা সে সময় বিশ্বকে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক হয়েই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে শত্রুমুক্ত যশোরে পৌঁছান। জিয়াউর রহমানের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ষাটের দশকে মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে ১৯৭২ সালে তাকেও দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তার নামেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মিলনায়তনের নামকরণ হয়।
×