ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রক্ষণভাগের কাণ্ডারি সাবেক তারকা জুয়েল রানা;###;টি ইসলাম তারিক

‘যতদিন বাঁচব ফুটবলের সঙ্গে থাকব’

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৪ নভেম্বর ২০১৫

‘যতদিন বাঁচব ফুটবলের সঙ্গে থাকব’

সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে সারেং যেমন ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেন, আকাশে অভিজ্ঞ বিমান চালক যেমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াই সব যাত্রীদের নিয়ে নিরাপদে রানওয়েতে ফিরে আসেন, ঠিক তেমনি ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষ দলের মুহুর্মুহু আক্রমণ রুখে দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে যার জুড়ি মেলা ভার তিনি আমাদের একসময়ের ফুটবল মাঠের রক্ষণভাগের কা-ারি। ‘মজবুত দেয়াল’ খ্যাত সেই প্রিয় খেলোয়াড় জুয়েল রানা। সুনামগঞ্জ দেশের বাড়ি হলেও জন্ম ঢাকার আগারগাঁও। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী বাড়ি-ঘর জালিয়ে দিলে শংকরের একটা বাসায় পরিবারের সঙ্গে ছোটবেলা কেটেছে জুয়েল রানার। স্কুল জীবন কেটেছে পশ্চিম ধানম-িতে। ফুটবলের হাতেখড়ি সেই স্কুল জীবন থেকেই। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে বল নিয়ে ছোটাছুটি। ছুটির পর আবাহনী ক্লাবে গিয়ে খেলোয়াড়দের অনুশীলন দেখা। মাঝেমধ্যে নিজেই মাঠে নেমে পড়া। এভাবেই ধীরে ধীরে ফুটবলের সঙ্গে গভীর প্রেম জমে উঠে জুয়েলের। আর সেই থেকেই নীল-আকাশির অর্থাৎ আবাহনীর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা জন্মে যায় তার। ১৯৭৮ সালে মামার সঙ্গে সর্বপ্রথম ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখেন আবাহনীর গ্যালারিতে বসে। ম্যাচটি ছিল আবাহনী বনাম রহমতগঞ্জের। সেই ক্ষণটি তার আজও মনে আছে। তখন তিনি কখনই ভাবেননি একদিন এই মাঠেই তিনি দাপিয়ে বেড়াবেন। বাবা মার দেয়া জুয়েল নামটার প্রতি সুবিচার করেছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সেদিনের সেই ছোট্ট জুয়েল একসময় মাঠ কাঁপিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দল ও দেশের বড় বড় ক্লাবের হয়ে। মাঠে দৃষ্টিনন্দন ধারাবাহিক পারফর্মেন্স প্রদর্শন করে তিনি হৃদয় জয় করেছেন লক্ষ্য লক্ষ্য ভক্ত-সমর্থকের। ঢাকার ফুটবলের দুই পরাশক্তি আবাহনী ও মোহামেডান। জুয়েল রানা আবাহনীর সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ফুটবল জীবনে কখনই প্রিয় ক্লাবটিতে খেলা হয়নি। অবশ্য এটা নিয়ে তার কোন আফসোস নেই। তিনি খেলোয়াড়ি জীবনে অত্যন্ত প্রফেশনাল ছিলেন। যখন যে দলে খেলেছেন নিজের সর্বোচ্চ ও সেরাটা উজাড় করে দিয়েছেন। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে ১৯৮৮ সালে প্রথম মাঠে নামেন জুয়েল। ওই বছর রক্ষণভাগে চমৎকার নৈপুণ্য দেখালে পরের বছরই যোগ দেন জনপ্রিয় দল ঢাকা মোহামেডানে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৯ সালেই নিজ যোগ্যতার বলেই ঠাঁই করেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। চতুর্থ সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন তিনি। যা তাকে আজও শিহরিত করে। জুয়েল রানা বলেন, ১৯৯৯ সালে সাফ ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারে অনেক রথী-মহারথীদের সঙ্গে খেলেছেন জুয়েল। মূলত নান্নু, মঞ্জু, সালাহ উদ্দিন, এনায়েত, মেজর হাফিজদের খেলা দেখেই ফুটবলে অনুপ্রাণিত হন তিনি। এসব তারকাদের খেলা যখন দেখেছেন তখন বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ছিল না তার। নিজের সমসাময়িক ফুটবলারদের মধ্যে কায়সার হামিদ, সাব্বির, সম্রাট হোসেনে এমিলির খেলা ভাল লাগত। তিনি জানান, বিদেশী খেলোয়াড়ের প্রতি আলাদা কোন আকর্ষণ কখনই ছিল না! দেশের ফুটবলের উন্নতির জন্য কি করা উচিত এ প্রসঙ্গে অনেক খোলামেলা কথা বলেন জুয়েল। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। হুট করে সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাবেক এই তারকা ডিফেন্ডার। জুয়েল বলেন, বয়সভিত্তিক ফুটবল যতদিন চালু না হবে ততদিন এদেশে ফুটবলের উন্নতি চোখে পড়বে না। বয়সভিত্তিক বলতে শুধু অনূর্ধ ১৪ বা ১৬ দল নয়, তিনি চান ৬ থেকে ২০ পর্যন্ত বয়সভিত্তিক। তার মতে, বাবা-মা তার ৬ বছর বয়সী ছেলেকে একাডেমিতে দিয়ে যেন নিশ্চিত হতে পারে যে তার ছেলে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি ফুটবল চর্চাও করতে পারবে। বাচ্চাদের শিক্ষানবিশ সময়ে কোন অবস্থাতেই বকাঝকা করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাদের বিরুদ্ধে এমন কোন কাজ করা যাবে না যার কারণে তারা ফুটবল চর্চার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ জন্য প্রয়োজন ভাল একাডেমি প্রয়োজন ভাল পরিবেশ। সঠিকভাবে পরিচালনা করলেও সেক্ষেত্রে সময় লাগবে বলে মনে করেন জুয়েল। তার মতে, সঠিক পরিকল্পনামাফিক এগুলে ২০ বছর পর বাংলাদেশ ফুটবলে অবশ্যই সাফল্যের মুখ দেখবে। দেশের ফুটবলের বর্তমান অবস্থা নিয়েও কথা বলেন জুয়েল। তার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের খেলার মান বেশ বেড়েছে। এটা ধরে রাখতে পারলে আরও ভাল করা সম্ভব। পাশাপাশি অনূর্ধ দলগুলোর খেলা নিশ্চিত করতে পারলে ফুটবলের মান বাড়তে বাধ্য। জুয়েল রানা ক্লাবের এবং দেশের হয়ে বহু দেশ সফর করেছেন। ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, কাতার, বাহরাইনসহ অনেক দেশ। ফুটবলে জুয়েলের সবচাইতে কষ্টের বিষয় ‘পুল’। সে সময় পুল প্রথা ফুটবলের বিরাট ক্ষতি করেছে বলে মনে করেন তিনি । ওই সময় দেখা যায়, পুলের প্লেয়ার কম টাকার বিনিময়ে পুরো লীগ খেলছে পক্ষান্তরে বেশি দামি প্লেয়ার রিজার্ভ বেঞ্চে বসে আছে। জুয়েলের প্রশ্ন, তাহলে পুল করে কি লাভ হয়েছিল? এই বিষয়টা অনেক খেলোয়াড়ের মতো তাকে আজও ভীষণ কষ্ট দেয়। ঢাকা লীগে অনেক স্মরণীয় খেলা আছে জুয়েলের। তবে একটি খেলার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেন তিনি। ম্যাচটি ছিল মোহামেডান বনাম মুক্তিযোদ্ধা। সেটা ১৯৯৫ সালের লীগের খেলা। মুক্তিযোদ্ধা প্রথম অর্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। মোহামেডান একটা পেনাল্টি পেলে জুয়েল রানা কিক করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গোল করতে ব্যর্থ হন তিনি। যে কারণে মোহামেডান মানসিকভাবে আরও চাপে পড়ে যায়। পরবর্তীতে দুই বেদেশী লাডিবাবা লোলা আর বডিবাবা লোলা দু’জনে মোহামেডানের পক্ষে গোল করলে খেলায় সমতা আসে ২-২ গোলে। শেষ সময়ে মোহামেডানের মুহুর্মুহ আক্রমণে দিশাহারা মুক্তিযোদ্ধা। খেলার অন্তিম মুহূর্তে একটা বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে মুনের আত্মঘাতী গোলে যখন মোহামেডান জয়লাভ করে তখন পশ্চিম গ্যালারির সে কি গগনবিদারী চিৎকার। বিষয়টি আজও শিহরিত করে জুয়েলকে। জুয়েল তার ফুটবল খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে তৃপ্ত। পুরো সময় আস্থা ও সম্মানের সঙ্গেই খেলেছেন। যখন যে দলে খেলেছেন নিজেকে উজাড় করেই খেলেছেন। ২০০৭ সালে মোহামেডানের হয়েই খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানেন তিনি। জুয়েল রানার কোচিংয়ের প্রতি আগ্রহ আছে। ইতোমধ্যে তিনি কোচিংয়ে সি লাইসেন্স অর্জন করেছেন। আগামীতে বি লাইসেন্স নেয়ার ইচ্ছা আছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে শেখ রাসেলের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে। এক ছেলে আর এক কন্যাসন্তানের জনক জুয়েল রানা। যতদিন বাঁচবেন থাকবেন ফুটবলের সঙ্গেই থাকবেন বলে জানান। এ দেশের ফুটবলকে তিনি একটা ভাল অবস্থানে দেখতে চান। সে ক্ষেত্রে তিনি আবারও সেই পূর্বের কথাতেই ফিরে আসেন। বলেন, বয়সভিত্তিক ফুটবল যতদিন চালু না হবে ততদিন এদেশে ফুটবলের উন্নতি ভালভাবে চোখে পড়বে না। জুয়েলের মতে, পরিকল্পনামাফিক বয়সভিত্তিক ফুটবলের দ্বার উন্মোচন হোক। আর জেগে উঠুক দেশের ফুটবল।
×