ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইসরাইলী সমাজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৪ নভেম্বর ২০১৫

ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইসরাইলী সমাজ

ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইসরাইলী দখলদারী খোদ ইসরাইলের অভ্যন্তরে অস্থিরতা, হিংসা ও হানাহানি বাড়িয়ে তুলছে। এ পরিস্থিতি ইসরাইলী সমাজকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। আসফ গাভরান নামে এক প্রাক্তন ইসরাইলী সৈনিক সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এক নিবন্ধে এ স্বীকারোক্তি করেছেন। আসফ গাভরন বর্তমানে একজন ঔপন্যাসিক। ‘কনফেশনস অব এ্যান ইসরাইলী ট্রেইটর’ শিরোনামে পোস্টে প্রকাশিত সেই নিবন্ধে গাভরন ২৭ বছর আগে প্রথম ইন্তিফাদার সময়কার স্মৃতিচারণ করে এখনকার সঙ্গে পার্থক্য টেনেছেন। দেখিয়েছেন যে, তখন বিক্ষুব্ধ কিশোর-তরুণদের ছোড়া ইটপাটকেল পাথরের জায়গায় কালক্রমে আসে বন্দুক, রাইফেল, সুইসাইড বোমা এবং পরে আসে রকেট। কিন্তু এ পরিবর্তন গাভরনকে যত না উদ্বিগ্ন করেছে তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করেছে ইসরাইলী সমাজটা উত্তরোত্তর অশান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত ও কুৎসিত চেহারা ধারণ করার জন্য। নিজেদের ভেতরে আলাপ আলোচনায় ইসরাইলীরা অধিকতর জঙ্গী, ভীতিপ্রদ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, যা আগে কখনও ছিল না। ২০০৮ সালে গাজায় হামলার পর থেকে তাদের কথাবার্তায় মৌলবাদী প্রবণতা ফুটে উঠেছিল। হালে তা আরও ভয়াল রূপ নিয়েছে। গাভরন লিখেছেন, আজ ইসরাইল সরকার ও তার মুখপাত্ররা যা বলে সেটাকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বক্তব্য বলে ধরতে হবে। সেই বক্তব্য দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আছে অনুগত মিডিয়া আউটলেট। সেই বক্তব্য যারা খ-ন করতে চায়, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে এবং ভিন্ন বক্তব্য হাজির করে তাদের বিদ্রƒপ করা, হুমকি ধামকি দেয়া, ধিকৃত ও লাঞ্ছিত করা হয়। সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ সমর্থন করছে না এমন ইসরাইলীদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখা যায়। গত বছর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনীদের লক্ষ্য করে হামলার পাশাপাশি বামপন্থী বিরোধী সহিংসতারও বহু ঘটনা ঘটেছে। গত গ্রীষ্মে তেলআবিব ও হাইফায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে বামপন্থীরা প্রহৃত হয়েছে। হারেজ পত্রিকার বামপন্থী সাংবাদিক গিদিওন লেভীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছেন এক পার্লামেন্ট সদস্য- যুদ্ধের সময় এ অভিযোগের জন্য মৃত্যুদ- দেয়া হয়ে থাকে। কৌতুক অভিনেত্রী ওরনা বানাই ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরাইলীদের কার্যকলাপে আতঙ্ক প্রকাশ করেছিলেন এক সাক্ষাতকারে। এর পরই তার চাকরি চলে যায়। জনৈক ফিলিস্তিনীকে ছুরিকাঘাতের একটি ঘটনা পরিবেশন করায় এক ইসরাইলী টিভি নেটওয়ার্কের আরব সাংবাদিক ও তার ইহুদী ক্রুর ওপর হামলা হয়েছে। গাভরন আরও লিখেছেন যে, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সৌজন্য শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ কুৎসিত চেহারা নিয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে। ফেসবুকের পাতাগুলোতে প্রায়শই ইহুদী বামপন্থী ও আরবদের বিরুদ্ধে সহিংসতার আহ্বান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কথিত ঐকমত্যের সঙ্গে ভিন্ন কোন মনোভাব প্রকাশ পেলেই বর্ণবাদী ঘৃণা ও বিদ্বেষের জোয়ার বয়ে যায়। ফেসবুকে শ্যাডো লায়ন নামে একটি গ্রুপ এক আরব ও ইহুদীর বিয়ে কিভাবে বানচাল করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছে। এক ইহুদী চিত্রপরিচালক তার এক ছবিতে ইসরাইলী হামলায় নিহত ফিলিস্তিনী শিশুদের স্মরণে এক মিনিট মৌনতা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন বলে ইসরাইলজুড়ে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে তাকে সমানে ধিক্কার জানানো হয়েছে। অভিনেত্রী আইনাত ওয়েইজম্যান ফিলিস্তিনী পতাকা ছাপানো টি-শার্ট গায়ে দেয়ায় কত রকমের ঘৃণাপূর্ণ মন্তব্য তাকে শুনতে হয়েছে সেটা তিনি ‘শেষ’ নামক এক অসাধারণ নাটকে তুলে ধরেছেন। গাজায় সর্বশেষ দফা লড়াইয়ে ইসরাইলীদের মধ্যে ফিলিস্তিনীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ-সহিংসতার মাত্রা আরও একধাপ বেড়েছে। ফিলিস্তিনী বিদ্বেষ প্রচার ও প্রসারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা এবং সহযোগিতা করছে মূলধারার মিডিয়া। এই অপপ্রচার অতি সম্প্রতি তুঙ্গে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উদ্ভট এক বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, তৎকালীন ফিলিস্তিনী আরব নেতা জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হাজ আমীন আল-হুসাইনীর কাছ থেকে পরামর্শ পাওয়ার পরই হিটলার ইহুদী নিধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইহুদীদের এমনি ঘৃণা বিদ্বেষ ও অপপ্রচারের মুখে ফিলিস্তিনীরা অনেক সময় সাধারণ ছুরি ও স্ক্রু-ড্রাইভারের মতো সরঞ্জাম নিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছে। এমন ক্ষেত্রে ওদের গুলি করে হত্যার আহ্বান জানাচ্ছে ইহুদীরা। ইমাইর লাপিদ নামে এক দক্ষিণপন্থী নেতা নসিহত করেছেন- ‘আক্রমণের শুরুতে গুলি করে মেরে ফেলতে দ্বিধা কর না। কেউ ছুরি দেখালে তাকে গুলি কর।’ ইসরাইলী জননিরাপত্তা মন্ত্রীও এমন বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। জেরুজালেমের পুলিশপ্রধান বলেছেন, কেউ কোন ইহুদীকে ছুরি মারলে বা জখম করলে তাকে মেরে ফেলা হবে। এমন মনোভাব থেকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। পূর্ব জেরুজালেমে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছিল বলে সন্দেহভাজন ফিলিস্তিনী যুবক ফাদি আলুনকে পুলিশ ঘেরাও করে তারপর গুলি করে মেরেছে। এ ধরনের গুলি করে ও অন্যান্যভাবে হত্যার ঘটনা আরও ঘটেছে। আসফ গাভরন তার নিবন্ধে লিখেছেন যে, ইসরাইলের অভ্যন্তরে এসব ঘটনা হয় ইহুদীদের কথাবার্তায় ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও বর্ণবাদী সুরের পরিণতি এবং ওই সব কথাবার্তার উৎপত্তি হয়েছে ৪৮ বছর অন্য জনগোষ্ঠীর ভূখ-ের ওপর দখলদারী থেকে। তিনি আরও লিখেছেন- ‘এই দখলদারীর অবসান আমাদের নিজেদের জন্যই ঘটাতে হবে। কারণ আমাদের এখন কোন নিরাপত্তাবোধ নেই। আমরা কূটনীতিক দিক দিয়ে একঘরে হয়ে পড়েছি। সারাবিশ্বে আমাদের ঘাতক, মিথ্যাচারী ও বর্ণবাদী হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
×