স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ কিস্তি। অতি পরিচিত শব্দ এখন গ্রামেগঞ্জের অতি সাধারণ কর্মজীবী মহিলাদের মুখে মুখে ঘুরছে। এই ‘কিস্তি’ তাদের সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে। বাড়ি বাড়ি কাজ করে বিধবা গরিব নারী বা চাতালের শ্রমিক অথবা ধার দেনা করে হাত পেতে অপরের করুণা নিয়ে বেঁচে আছে এমন কর্মজীবীকে সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে কিস্তি পরিশোধের চিন্তা। এই কিস্তির আড়ালে কাজ করছে বড় আকারের এক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ প্রতারক। এরা কোনভাবে সমাজ কল্যাণ বিভাগের সার্টিফিকেট নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে বাহারী নাম দিয়ে বেসরকারী সংস্থা বা এনজিও। এদের কাজ হচ্ছে গ্রামীণ জনপদে অতি সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ আত্মসাত করা। চারটি পৌরসভা, ৪৫টি ইউনিয়নসহ জেলার প্রায় সাড়ে এগারোশ’ গ্রামের প্রত্যেকটিতে এখন এদের অবস্থান। শহরতলীসহ এসব গ্রামেগঞ্জে সাইনবোর্ডসর্বস্ব এনজিও ঋণ দেবার নামে প্রতারণা করে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাত করে চলেছে। কোন কোন গ্রামে এদের ঋণ দেবার পরিমাণ (সবার মিলিয়ে) ১০ থেকে ২০ লাখ টাকাও রয়েছে। সর্বনিম্ন মহল্লাভিত্তিক পাঁচ লাখ টাকার কম নয়। এসব তথাকথিত এনজিও প্রথমে শুরু করে সমাজ সেবা দিয়ে। প্রতিটি গ্রামের বেকার শিক্ষিত যুবকরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এনজিও নামের অফিস খুলে বসেছে। তাই কোন কোন গ্রামে একের অধিক এসব তথাকথিত ভূঁইফোড় এনজিও গজিয়ে উঠেছে। এসব বেকার যুবকদের অধিকাংশ কোন না রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। তবে এসব কাজে খুবই সিদ্ধহস্ত মৌলবাদী গোষ্ঠী বা দল। তাদের উৎসাহে ও অর্থায়নে এসব এনজিও গড়ে উঠেছে। জেলা সমাজ সেবা অফিস সূত্র স্বীকার করেছে এ ধরনের এনজিও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পুরো জেলায় শতাধিকের কম নয়। এরা গ্রামের নিরীহ অসহায় মানুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রলোভনের প্যাকেজ তুলে ধরে গ্রাহক করে। তারপর তাদের নানান কাজের নামে নির্দিষ্ট টাইম বেঁধে দিয়ে বিনা সুদের নামে টাকা ধার দিয়ে থাকে। যার পরিমাণ কম করে এক হাজার থেকে শুরু করে দশ হাজার পর্যন্ত। শর্ত থাকে পরিশোধ করতে হবে কিস্তিতে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার না হতেই সঞ্চয় সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়ে। পরে চড়া বা চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। বড় বড় নামকরা এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্যাংঙ্কিং স্টাইলে যেভাবে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ভূঁইফোড় এসব প্রতিষ্ঠান স্টাইল কিছুটা চেঞ্জ করে ঋণের টাকা উঠাতে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কোন গরিব গ্রাহকের ছাগল বা গরু কিংবা মুরগি থাকলে তারা টার্গেট করে ঋণ পরিশোধে। নিজেরা (এনজিও ও কর্মী) তা উঠিয়ে না নিয়ে গিয়ে গ্রাহককে বিক্রি করতে বাধ্য করে। পরে সেই টাকা ছিনিয়ে নেবার স্টাইলে সুদসহ বুঝে নেয়। এরা প্রথমে গ্রামটিতে এ ধরনের গরিব অসহায় মানুষের সংখ্যা কত তা জরিপ করে তালিকা তৈরি করে। তালিকা ধরে মাঠকর্মীরা তার কাছে গিয়ে ঋণ দেবার প্রস্তাব করে। এভাবে খেটে খাওয়া দিনমজুর, বিধবা মহিলা বা চাতালের শ্রমিকদের তাদের চালে বেঁধে জিম্মি করে ফেলে। তারপর ঋণ দেয়া হয় কিস্তি করে। কিন্তু সে কিস্তি থেকে গ্রাহক আর বেরিয়ে আসতে পারে না। গোমস্তাপুরের বোয়ালিয়া গ্রাম। এখানে এ ধরনের অসহায় মহিলা বা গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। তারা নিয়মিত প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধ করেও ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। অনরূপ শিবগঞ্জের ধাইনগর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের মহিলা ঋণদাতারা কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে গরু, ছাগল, মোরগ মুরগিসহ অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করেও কূলকিনারা পাচ্ছে না। এই চিত্র পুরো জেলার সাড়ে এগারোশ’ গ্রামের। কোন কোন সময়ে কোন সঞ্চয়কারী বা ঋণ গ্রহীতা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে ঘরোয়া সমঝোতা করে ফয়সালা করে। এসব এনজিও কর্মকর্তারা সজাগ থাকে যাতে কেউ আইনের আশ্রয়ে বা থানা পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ না করে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: