ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় প্রকাশকদের

অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে, মৃত্যুর হোক লয়

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৫ নভেম্বর ২০১৫

অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে, মৃত্যুর হোক লয়

মোরসালিন মিজান ॥ ব্লগে আপন মনে লেখা। নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ। অন্যের কাছে তা ভাল লাগবে কিংবা মন্দ। উভয় অনুভূতির কথা লিখে জানানোর ব্যবস্থা আছে। যুক্তিতর্ক যা, ব্লগেই হতে পারে। কিন্তু না, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অংশটি সে পথ মাড়ালো না। তারা, যাকে অপছন্দ, ব্লগার নাম দিয়ে খুন করল। খুন করে চলেছে। নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন বেশ কয়েক ব্লগার। আর তার পর ভয়ঙ্কর থাবা। এবার প্রকাশনা শিল্পের ওপর। এরই মাঝে নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়েছেন দুই প্রকাশক। নিজের অফিস কক্ষে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে জাগৃতি প্রকাশনের কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। টগবগে তরুণ। আহা, কী সরল দেখতে! নির্বিবাদী এই মানুষটিকে বই প্রকাশের ‘অপরাধে’ মেরে ফেলা হয়েছে। এর সামান্য আগে আক্রান্ত হয় লালমাটিয়ায় অবস্থিত ‘শুদ্ধস্বর’। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহ্মেদুর রশীদ টুটুলকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। সঙ্গে আক্রান্ত হন দুই লেখক। এখন তারা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। সর্বশেষ, সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। জীবন নিয়ে যথেষ্টই শঙ্কিত তিনি। এভাবে ব্লগ থেকে বই পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে আক্রমণ। যে সমাজে বই আক্রান্ত হয়, আলো বলতে সেখানে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আলোটুকু যেন নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা। হ্যাঁ, কোন কোন প্রকাশক আতঙ্কিত হয়েছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কয়েকটি দিন গেছে তাদের। অনেকেই ভারাক্রান্ত। মেনে নিতে পারছেন না এই বর্বরতা। এ অবস্থায় কীভাবে অব্যাহত থাকবে প্রকাশনা? সামনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কতটা সম্ভব হবে স্বাধীনভাবে বই প্রকাশ? এমন প্রশ্ন উঠছিল। তবে প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে শোনা গেল আশার কথা। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চান তারা। পাঠকের প্রতি পেশাদার প্রকাশকের পাঠকের যে দায়, সেটি মেটাতে চান। প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান প্রকাশক মফিদুল হকের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এটা নির্দিষ্ট কোন বইয়ের ওপর আক্রমণ নয়। প্রকাশনা শিল্পের ওপর আক্রমণ। পৃথিবীতে এমন আক্রমণ নজিরবিহীন। কোন লেখা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু লেখক বা প্রকাশকের ওপর আঘাত করা যায় না। সমাজে নানা রকমের মানুষ বাস করে। নানা মতের পথের মানুষ নিয়ে সমাজ। একইভাবে প্রকাশকরাও নানা রকমের বই প্রকাশ করে থাকেন। সেটা দিয়েই তো সমাজ চলে। নানা ধরনের চিন্তা, নানা ধরনের ভাবনা, নানা দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া তো মননশীলতা চিন্তাশীলতা সৃষ্টিশীলতা কিছুই থাকে না। খুব চমৎকার করেই তিনি বলেন, আইডিয়া তো চকমক পাথর। একটির সঙ্গে অন্যটির ঘর্ষণ হবে। স্পার্ক করবে। খেলা করবে। কোন আইডিয়াই চূড়ান্ত কিছু বলে দিচ্ছে না। বই হচ্ছে চকমকি পাথর। সে জায়গাটা থেকে দেখলে, বইয়ের কারণে লেখক বা প্রকাশকের ওপর হামলা মেনে নেয়া যায় না। একটি চিন্তাকে আরেকটি চিন্তা দিয়ে প্রতিহত করতে হয়। বইকে আরেকটা বই দিয়ে প্রতিহত করতে হয়। সর্বোপরি আইনের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। অথচ একটি অংশ মানুষ খুন করছে। আসলে ওরা চিন্তাশীলতা যুক্তিবাদিতা মনন চর্চার সব পথ রুদ্ধ করতে চায়। রুদ্ধ করতে চাচ্ছে ধর্মের অজুহাতে। ধর্মকে তার উচ্চ স্থান থেকে নামিয়ে আনছে এরা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে। এরা সমাজকে হত্যা করতে চাচ্ছে। সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করাসহ সব ধর্মপ্রাণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানবিক মানুষদের সঙ্গে নিয়ে এদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান তিনি। দীপন ও টুটুলের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই তরুণরা বাংলাদেশের প্রকাশনার ভবিষ্যত প্রতিনিধি। নানা মত-পথকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশনাকে তারা সমৃদ্ধ করে চলেছে। তাদের ওপর আক্রমণ মানে, ভবিষ্যত প্রকাশনার ওপর আক্রমণ। তিনি বলেন, যারা এটা করছে তারা চরম একটা অন্ধত্বের মাঝে বাস করছে। সমাজের মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কেও তাদের চরম মূর্খতা। বোধহীনতা। একজন প্রকাশকের দ্বায়িত্ব তো লেখক ও পাঠকের মাঝে সেতুবন্ধন করে দেয়া। নানা রকমের পান্ডুলিপি ব্যবহার করেন। সেখানে তার ওপর কেন আক্রমণ করা হবে? সমাজের অগ্রগতির কথা চিন্তা করেই বই প্রকাশ অব্যাহত রাখা হবে বলে জানান তিনি। প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনরতদের অন্যতম শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান বলেন, মৌলবাদীরা কোন দিনই বইকে গ্রহণ করেনি। এরা অন্ধকার যুগে ছিল। সেখানেই থাকতে চায়। আমাদের প্রায়শই হুমকি দিয়ে থাকে। তবে এই হুমকিতে থেমে গেলে পাঠক বঞ্চিত হবে। সমাজ এগিয়ে যেতে পারবে না। তিনি বলেন, লেখক প্রকাশকদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় আমার শোকাহত। তবে থেমে যাওয়ার নই। অমর একুশে গ্রন্থমেলা সামনে রেখে যেসব বই প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল, সবই প্রকাশিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। জাগৃতি প্রকাশনের পাশেই উৎস প্রকাশনের অফিস। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মোস্তফা সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, আধা ঘণ্টা আগে আমি দীপন ভাইকে দেখেছি। সেই তরতাজা বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ। সুন্দর মনের উচ্চ শিক্ষিত এই প্রকাশক বন্ধুর ওপর কেউ আক্রমণ করতে পারে কোন দিন ভাবিনি। অথচ তাই হয়েছে। তিনি বলেন, শুদ্ধস্বরের প্রকাশক টুটুলের ওপর আক্রমণের খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলাম। ঠিক তখন দীপন হত্যার দুঃসংবাদটি আসে। তিনি বলেন, এই বেদনা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। এমন ঘটনা আতঙ্কেরও বটে। তবে, আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য সফল হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, সামনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বই প্রকাশের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ অবস্থায় প্রকাশক হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব সেখান থেকে সরে আসার প্রশ্ন আসে না। স্বাধীন চিন্তার প্রাধান্য দিয়েই বই প্রকাশিত হবে। গ্রহণ-বর্জনের স্বাধীনতা পাঠকের। সবচেয়ে বড় কথা, আহত প্রকাশক টুটুল মৌলবাদী আক্রমণে ভীত নয় বলে জানিয়েছেন। তার প্রকাশনা একইভাবে অব্যাহত থাকবে। প্রায় একই কথা শোনা গেল অন্য অনেক প্রকাশকের কণ্ঠে। তারাও জানান, স্বাধীনভাবে বই প্রকাশ করে যেতে চান। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা জরুরী। সে সহায়তা তারা খুব করে চান। সকলের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়াক প্রকাশনা শিল্প। নতুন প্রাণ পাক। কবিগুরুর ভাষায় বলি- অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মৃত্যুর হোক লয় ...।
×