ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৬ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোর থেকে উত্তরণ (৪ নবেম্বরের পর) ভারত বিভক্তি আমাদের হিসাবে ছিল না এবং সেজন্যই কেবিনেট মিশনের কনফেডারেশন প্রস্তাব মুসলিম লীগ সহজেই গ্রহণ করে। অখ- ভারতে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণই যথেষ্ট ছিল। কংগ্রেসের একগুঁয়েমিতে এবং বিশেষ করে শেষ পর্যায়ে প-িত নেহরু ও সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের অনমনীয় অবস্থানের কারণেই কিন্তু ভারত বিভক্ত হয়। যাহোক, ১৯৪৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিল যে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সভাপতিত্ব করবেন এবং তিনি যে কোন সরকারী নথি তলব করতে পারবেন এবং তার সিদ্ধান্ত হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এমনকি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তও তিনি নাকচ বা পরিবর্তন করতে পারবেন। এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই পরবর্তীকালে গোলাম মোহাম্মদের মতো দুষ্ট ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছামত বিতাড়নে ও জনমতের জন্য সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ রাখতে বিমুখ হতে উদ্বুদ্ধ করে। পাকিস্তানে সরকারী দল পরিত্যাগ করে রাজনীতি করাটাও হয়ে যায় বিপজ্জনক; পূর্ববাংলা পরিষদে ১৭১ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে মাত্র ১৭ কি ২০ জন সদস্য মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে বিরোধী দলে যোগ দেন। সরকারী দল তাদের জনসমর্থনে ভাটা অনুধাবন করে ১৯৪৯ এর পরে প্রায় পাঁচ বছর পূর্ববাংলায় ৩৪টি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে শূন্যতা সৃষ্টি হলেও কোন উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। ১৯৪৯ সালের ১ মে-তে অনুষ্ঠিত হয় এই পরিষদের সর্বশেষ উপনির্বাচন যাতে গরিব ছাত্রনেতা শামসুল হকের কাছে পরাজিত হন খ্যাতনামা আশরাফ গোত্রীয় নেতা খুররম খান পন্নী। স্বৈরাচারী কর্মকা- পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় সরকারকে ইচ্ছামতো প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা দেয়া হয় এবং প্রদেশের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার হরণ করা হয়। এই ব্যবস্থাটিই ঘৃণিত ‘৯২ক ধারার শাসন ব্যবস্থা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই আইনে পশ্চিম পাঞ্জাবে দুই বছর, সিন্ধু প্রদেশে তিন বছর ও পূর্ববাংলায় প্রায় এক বছর কোন গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। এই অন্যায় ও স্বৈরাচারী ক্ষমতা সামরিক শাসন জারির আগে মোট দশবার প্রয়োগ করা হয় - এক বার পূর্ববাংলায়, তিনবার পশ্চিম পাঞ্জাবে, চার বার সিন্ধু প্রদেশে এবং দুইবার সীমান্ত প্রদেশে। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইন করে কেন্দ্রীয় পুলিশকে নিবর্তনমূলক গ্রেফতারি ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। প্রাদেশিক পুলিশের অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ নাগরিকরা আর একটি যাঁতাকলের চাপে পড়ল। কোনভাবেই বিরোধিতা বা সমালোচনা বানচাল করা হলো স্বৈরাচারের আর একটি ব্রত। পাকিস্তান এক্ষেত্রেও আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে। মওলানা ভাসানী আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি পূর্ববাংলা পরিষদে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। আর যাবে কোথায়; সঙ্গে সঙ্গেই তার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারে তার সদস্যপদ খারিজ করে দেয়া হলো। বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে শামসুল হক ১৯৪৯ সালে উপনির্বাচনে জিতে গেলেন; কিন্তু ভুয়া নির্বাচনী মামলা দিয়ে ১৯৫১ সালে ট্রাইব্যুনালের বিচারে তার নির্বাচন বাতিল করে দেয়া হলো। একেবারে ফ্যাসিবাদী কায়দায় বিরোধিতা দমনের যজ্ঞে লিপ্ত হয় কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার। তারই বীভৎস প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ দিনব্যাপী গুলিবর্ষণ, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার, বাক-স্বাধীনতা হরণ এবং নির্যাতনের মাধ্যমে। কৈশোর থেকে উত্তরণ হলো স্বৈরতন্ত্র এবং বৈষম্যনীতির প্রতিবাদ করে। স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে যে আনন্দ ছিল ও যে প্রত্যাশা জন্মে তা কিন্তু অচিরেই পরিণত হয় নিরাশায় এবং পরিবর্তে ক্ষোভ ও দ্রোহ হয়ে যায় আমাদের চরিত্র ও আচরণে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই দেখা গেল যে, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিল তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ভারত থেকে স্থানান্তরিত মোহাজের গোষ্ঠী। প্রায় সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানে হিজরত করলেন। শুরু থেকেই তারা পূর্ব-বাংলার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণ করলেন। যেমন- সাতচল্লিশ সালেই রাষ্ট্রভাষার চিন্তা-ভাবনার সূচনা হলো এবং সেখানে প্রাধান্য পেল ইংরেজী ও উর্দু। সেখানে তখনকার সময়ের ৬৩% জনগোষ্ঠী বাঙালীর ভাষার কোনই কদর ছিল না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, একজন বাঙালী নিবেদিত নেতা ফজলুর রহমানই হয়ে গেলেন এই ভ্রান্ত উদ্যোগের মূল ব্যক্তি। পরবর্তী সময় ব্যাপকহারে পাঞ্জাবে ও সিন্ধু প্রদেশে ভারতীয় মুসলমান মোহাজেরদের আগমনে এবং হিন্দু ও শিখদের ভারতে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৫৬ শতাংশে নেমে যায়। ১৯৪৮ সালে ৬ ভাষাবিরোধ হয়ে গেল পাকিস্তানের একটি বড় বিষয়। ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদের কার্যকরী অধিবেশন শুরু হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। গণপরিষদের সদস্য ছিলেন ৬৯ জন। তার ৪৪ জন ছিলেন পূর্ববাংলার সদস্য আর ২৫ জন ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য। পূর্ববাংলার ৪৪ জন সদস্যের মধ্যে সরকারী দল মুসলিম লীগের ছিলেন ৩১ জন আর বিরোধী দল কংগ্রেসের ছিলেন ১৩ জন। মুসলিম লীগ সদস্যদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন ৬ জন। যথা- মোহাজের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পাঞ্জাবী অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ, মোহাজের ড. মাহমুদ হোসেন, মোহাজের ড. ইশতিয়াক হোসেন কোরেশী, মোহাজের মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বোনঝি বেগম শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ। জন্মসূত্রে বাঙালী ছিলেন এবং তার বিয়ে হয় এম. ইকরামুল্লাহ আইসিএসএস-এর সঙ্গে বিভাগপূর্বকালে। এম. ইকরামুল্লাহ ছিলেন মধ্যপ্রদেশের লোক, পাকিস্তানে তিনি হিজরত করে হলেন দেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। এই দম্পতি সেই যে করাচিতে গেলেন, হয়ে গেলেন সেখানকার স্থায়ী অধিবাসী। তাই বেগম ইকরামুল্লা হয়ে গেলেন সাত নম্বর পূর্ববাংলার প্রতিনিধি, যিনিও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। করাচিতে তাদের নিবাস স্থাপন করেন। প্রথম অধিবেশনেই বিরোধীদলীয় নেতা রাজকুমার চক্রবর্তী প্রস্তাব করলেন যে, গণপরিষদের অন্তত বছরে একটি সভা পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রস্তাবটি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নাকচ করে দিলেন। দ্বিতীয় প্রস্তাব করলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, গণপরিষদের ভাষা হবে ইংরেজী ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাও। এই প্রস্তাবের পক্ষে মুসলিম লীগের কতিপয় সদস্যও বক্তব্য রাখলেন। কিন্তু ভীষণ শক্তভাবে আপত্তি জানালেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি আরও বললেন, দেশকে বিভক্ত করার একটি চক্রান্ত হচ্ছে এই সংশোধনী প্রস্তাব। তিনি সরাসরি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললেন, দশ কোটি ভারতীয় মুসলমানের দেশ হলো পাকিস্তান এবং তারা উর্দুতে কথা বলে। ২৫ ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদে ভোটের জোরে মুসলিম লীগ দল এই সংশোধনটি নাচক করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা প্রতিবাদে সরব হয়। ২ মার্চে তারা একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং ১১ মার্চে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট ঘোষণা করে। ১১ মার্চে পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এবং প্রায় ৬৯ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এদিকে ১৯ মার্চে পাকিস্তানের জনক গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব বাংলা সফরের ব্যবস্থা পাকাপাকি ছিল। এই সফরকে নিশ্চিত ও কার্যকর করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তড়িঘড়ি করে ছাত্রদের সঙ্গে ১৫ মার্চ তারিখে ৮ দফা চুক্তি সম্পাদন করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যথাসময় ঢাকা এলেন এবং ২১ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং ২৪ মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণে ঘোষণা করলেন যে, তার মতে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তিনি আরও বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তিনি আরও বললেন যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তানবিরোধী এবং হিন্দু জনমত। জিন্নাহ সাহেবের ভ্রমণের ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সাময়িকভাবে থেমে গেল। তবে মাঝে মাঝেই বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান দুটো উদ্যোগ নিলেন। একটি ছিল রোমান হরফে বাংলা লেখা এবং আর একটি ছিল আরবী শিক্ষার প্রসার। এই দু’টি উদ্যোগই পূর্ব-বাংলায় মোটেই গৃহীত হলো না। ছাত্রদের সঙ্গে তার বৈঠক হলো কিন্তু কোন ঐকমত্য স্থাপিত হলো না। নানা কারণে যেমন, দুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাপে পড়ে- রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি চাপা পড়ে গেল। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগের সম্মেলন হলো। সেই সম্মেলন শেষে ২৭ জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এতেই শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন ছাত্রমহল, সরকারী কর্মচারী এবং শিক্ষিত মহলেই প্রথমে সীমাবদ্ধ থাকে। তারা ঠিক করেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে তারা দেশজুড়ে বিক্ষোভ করবেন। সভা-সমিতি করবেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেবেন। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এই উদ্যোগকে ব্যর্থ করার জন্য আইনের অপব্যবহার করে ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী ঢাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এরই মধ্যে রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে একটি সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয় এবং নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পরে তারা একটি সভায় বসে এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলেন। চলবে...
×