ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ নভেম্বর ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম

সলম শব্দমূল থেকে ইসলাম শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ শান্তি। যা অশান্তি সেটাই সন্ত্রাস। ইসলাম দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসলাম ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তির নিশ্চয়তা বিধান করে। ইসলাম জীবনের পরতে পরতে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করে। রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতু আখিরাতে হাসানাতুও ওয়াকিনা ‘আযাবুন্ নার- হে আমাদের রব! আমাদেরকে দান করুন দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের কল্যাণ এবং আমাদেরকে অগ্নি শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে আইয়ামে জাহিলিয়াতের নিকষ কালো অন্ধকার ও অজ্ঞতা দূরীভূত করে এক অনন্য আলোকধারার স্ফুরণ ঘটিয়ে নূরের অবয়ব নিয়ে মানব সুরতে। তাঁর আবির্ভাব ঘটে সমগ্র মানবজাতির জন্য। তিনি রহমাতুল্লিল ‘আলামীন বিশ্ব জগতের জন্য রহমত। আইয়ামে জাহিলিয়াতে মানুষ মনুষ্যত্বকে হারিয়ে ফেলেছিল। সারা পৃথিবীতে তখন বিরাজ করছিল জোর যার মুলুক তার অবস্থা। অশান্তি আর সন্ত্রাসী কর্মকা- মানবতাকে কঠিন অরাজকতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সর্বত্র বিরাজ করছিল নৈরাজ্য ও নৈরাস্য। তখনকার পৃথিবীর সে এক করুণ হাল। তাঁর আবির্ভাব ঘটল এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে যখন সমগ্র পৃথিবীর মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে, অশান্তির অন্ধকারে, র্শিক ও কুফরের অন্ধকারে, কুসংস্কার-অন্ধ বিশ্বাস ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে, পাশবিকতা ও লোলুপতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সর্বত্র লুটতরাজ, হানাহানি, মারামারি, খুনোখুনী, ছিনতাই, রাহাজানি, ব্যভিচার, অবিচার, জুলুম-নির্যাতন তথা নানা মাত্রায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বিরাজ করছিল। তিনি এসে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করার ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : লাতুফ্সিদু ফিল্ আরদ্- পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি কর না (সূরা বাকারা : আয়াত ১১)। যারা সন্ত্রাসী, যারা অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী তারা মানবতার দুশমন, তারা শয়তানের দোসর। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আল্ ফিত্নাতু আশাদ্দু মিনাল্ কাত্ল- ফিতনা, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ইত্যাদি হত্যার চেয়েও মারাত্মক (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯১)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ২০ বছর বয়সে মক্কা মুকাররমা থেকে অশান্তি, সন্ত্রাস, অরাজকতা দূর করার জন্য আর্তমানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করার লক্ষ্যে একটি সমাজসেবা সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সদস্যগণ আল্লাহ্র নামে হল্ফ বা শপথ করেন : মক্কা নগরীতে কারও ওপর জুলুম করা হলে আমরা সবাই মিলে জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব এবং ঐক্যবদ্ধভাবে মজলুমকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করব; চাই সে উচ্চশ্রেণীর হোক কিংবা নিচু শ্রেণীর হোক। মজলুমের প্রাপ্য যতক্ষণ আদায় না হবে ততক্ষণ আমরা তা আদায় করে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রাখব। আমরা একে অপরের আর্থিক মদদ করব। এই সেবা সংগঠনটি হিল্ফুল ফযুল নামে মশহুর হয়। এই হিল্ফুল ফযুল মক্কায় শান্তি, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। এর মাত্র ১৫ বছর পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম ৩৫ বছর বয়সে মক্কার কা’বা গৃহের সংস্কারকালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে আভিজাত্যের দম্ভে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম থেকে উদ্ধার করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। এর ৫ বছর পর ৪০ বছর বয়সে তিনি হীরা গুহায় প্রথম ওহী লাভ করেন। এর পরেও তিনি বলতেন : সেই হল্ফকারীদের কেউ যদি আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব। তিনি এও বলতেন : ইসলাম ওই হল্ফকে রহিত তো করেইনি, বরং অধিকার শক্তিশালী করেছে। হিল্ফুল ফুযুল শান্তি স্থাপনে এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধে এক অনুসরণীয় সংগঠন। সমাজের সবাই যদি সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাস দমনে তৎপর হয় তা হলে সমাজে অশান্তি থাকতে পারে না, তাহলে বিশৃঙ্খলা, ফিত্না, ফাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা থাকতে পারে না। কুরআন মজীদে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : আর দুনিয়ায় যারা ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হচ্ছে- তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩৩)। আরও ইরশাদ হয়েছে : তোমরা প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ বর্জন কর, যারা পাপ করে অচিরেই তাদের পাপের সমুচিত শাস্তি দেয়া হবে (সূরা আন‘আম : আয়াত ১২১)। যমিনে শান্তি স্থাপনের জোর তাগিদ দিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না (সূরা আ‘রাফ : আয়াত ৫৬)। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না, আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভাল বাসেন না (সূরা কাসাস : আয়াত ৭৭)। মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ওদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান (সূরা রুম : আয়াত ৪১)। সন্ত্রাসীদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবনের চলমান গতিতে সন্ত্রাসবাদীরা ছন্দপতন ঘটায়, অশান্তি, ত্রাস এবং অন্যায় আচরণ প্রয়োগ করে। তারা এমন কোন পাপকর্ম নেই যার থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সামর্থ্য হয়। ওরা মূলত সামাজিক জঞ্জাল। এই জঞ্জাল দূর করার দায়িত্ব সমাজের সদস্যগণের। সন্ত্রাসমুক্ত, পাপমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবার জোর তাগিদ দিয়ে ইরশাদ হয়েছে : ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না, কিন্তু পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসা করতে পার এবং একে অপরকে হত্যা কর না (সূরা নিসা : আয়াত ২৯), চোর সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক তাদের হস্ত ছেদন কর, এটা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ হতে আদর্শ দ- (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩৮)। ইরশাদ হয়েছে : নরহত্যা অথবা দুনিয়ার ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩২)। সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে জিহাদের কোন বিকল্প নেই। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×