এইচএম এরশাদ/মুহাম্মদ ছলাহ উদ্দিন, কক্সবাজার ॥ টেকনাফ-মিয়ানমার মংডুভিত্তিক সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় গত ২০ বছরে ৯৩৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। টেকনাফ স্থলবন্দর ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর থেকে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৩ হাজার ১১ কোটি ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৬ টাকার পণ্য আমদানি করেছে ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৯৯ টাকার পণ্য রফতানি করা হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের আমদানি পণ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের সীমান্ত বাণিজ্যে ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৭ টাকার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেলেও দেশীয় পণ্যের রফতানি খুবই কম। প্রতিবছর জ্যামিতিক হারে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স¤প্রসারণ ও বাণিজ্য ঘাটতিতে সমতা আনতে দু’দেশে ’জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠিত হয় এবং প্রতিমাসে বা ত্রৈমাসিক দফায় দফায় বৈঠক হলেও পণ্য রফতানিতে সুফল আসছে না। অবশ্য সরকারী কোষাগারে ৯শ’ ৩৪ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৩শ’ ৩১ টাকার রাজস্ব জমা হয়েছে এ পর্যন্ত।
১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর স্বল্প পরিসরে শুরু হওয়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য সম্ভাবনাময় একটি বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে টেকনাফ স্থলবন্দর আজ ২০ বছর পেরিয়ে ২১ বছরে পদার্পণ করেছে।
জানা যায়, প্রথম দিকে সীমান্ত বাণিজ্যে দু’দেশের অবস্থান কাছাকাছি থাকলেও পরবর্তীতে মিয়ানমার থেকে আমদানি বৃদ্ধি পেলেও রফতানি সূচক নিচের দিকে নামতে থাকে। যার ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। বৈধ বাণিজ্যের পাশাপাশি চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে ৮ ঘণ্টার পাস নিয়ে মিয়ানমারে যাওয়ার সময় চোরাচালানিরা বাংলাদেশী পণ্য টেক্সবিহীন নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সীমান্ত বাণিজ্যের গতিশীলতার লক্ষ্যে দু’দেশের সীমান্ত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ‘বর্ডার ট্রেড জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি’ গঠিত হয়ে ৮টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সীমান্ত বাণিজ্য স¤প্রসারণ ও সমস্যা দূরীকরণ, সুপারিশ এবং প্রস্তাবসহ বর্ডার হাট চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য আটক করলেও চোরাচালানিদের দমাতে পারছে না।
সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তারা পণ্য পাচার করে যাচ্ছে মিয়ানমারে। টেকনাফ শুল্ক স্টেশন দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে হিমায়িত মাছ রুই-কাতলা-ইলিশ, শুঁটকি মাছ, বিভিন্ন প্রকার কাঠ, বরই আচার, শুকনা বরই, টক তেঁতুল, সিøপার (রাবার/প¬াস্টিক), বাঁশ, বেত, মাষকলাই, মুগ ডাল, ফেলন ডাল, ছোলা, রিটা, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, চিকন জিরা, কাঠের তৈরি কিচেন ওয়্যার, তুলা, সুপারি, তরমুজ, বাম, বেড লিনেন, সাবান, লবঙ্গ, প্লাস্টিক শিট, শিমের বিচি, মিষ্টি জিরা (মৌরী), ছাতা, সেনেকা মাটি, গরুর চামড়া, শিমুল তুলা, গাছের ছাল, তেঁতুল বিচি, ক্রিম, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য রফতানিকৃত পণ্যের মধ্যে সিমেন্ট, গেঞ্জি, গেঞ্জির কাপড়, দেশীয় কাপড়, প্লাস্টিক পাইপ, মানুষের চুল, এ্যালুমিনিয়াম প্রোডাক্টস, হাঙ্গর মাছ, চামড়া, অক্স পেনিস, পাইস্যা মাছ, প্লাস্টিক স্পিল্ডার, ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী, টিউবওয়েল, পাতলা কম্বল, গাজী প্লাস্টিক ট্যাংক, মেডিসিন, ভেন্ডা ট্রিজ (রাসনা), দেশী টাওয়াল, শুঁটকি মাছ, চালকল মেশিন, প্লাস্টিক প্রোডাক্টস, তিলের দানা, কালারড পেপার, দেশী পলিথিন, সুতলি, সুগন্ধি হেয়ারওয়েল, শেভিংস ক্রিম, মেহেদী, ঘামাচি পাউডার, দেশী শুকনা মরিচ, মেলামাইন প্রোডাক্টস, টুথ পাউডার, সাবান, দেশী বোরকা, বাটা সু, ট্যাং, গাজী পাম্প, দেশী লুঙ্গি, জুট ব্যাগ, বিস্কুট, চানাচুর, সফ্ট ড্রিংকস, ওয়াল ঘড়ি, দেশী ইমিটেশন জুয়েলারি, ফিস প্যাকিং এসোস, কিচেন ওয়্যার অব উড, কিচেন ওয়্যার অব আইরন, দেশী সেমাই, আলু, দেশী আইরন গ্রিল, টাইলস, প্লাস্টিক ডোর, সিরামিক বাথস (কমোড), দেশী তিল, মুড়ি, বেবী শার্ট এ্যান্ড প্যান্ট, মেন শার্ট, প্লাস্টিক টর্চলাইট, ছাতা, টুপি, সিরামিক বেসিন, বাই-সাইকেল রিম্স, এসএস স্টিল পাইপ।
বন্দর ব্যবসায়ী মোঃ হাশেম জানান, স্থলবন্দরে বিরাজমান সমস্যা, মিয়ানমার জাতিগত সংঘাত ও মাদক ইয়াবার প্রভাবে সীমান্ত বাণিজ্যে প্রভাব পড়ে। তবে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কে ভাঙ্গন, বাণিজ্য পণ্য পরিবহন সমস্যা, অবকাঠামো সঙ্কট, পণ্য খালাস ও লোড-আনলোড স্থানে ছাউনি স্থাপন, পণ্য খালাসে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দাবি জানান। তিনি আরও জানান, মিয়ানমার সঙ্গে আগের মতো ব্যবসা করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার ব্যবসায়ীরা সহজে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্যবসা করতে পারলেও আমরা মিয়ানমার বাজারে অবাধে প্রবশে করে ব্যবসা করতে পারছি না। তাছাড়া রফতানি বৃদ্ধি করতে হলে মিয়ানমার বাজারে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করতে হবে।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবসা ২১ বছরে পদার্পণ করলেও নানা সমস্যা জর্জরিত। এ সব সমস্যার পরও ব্যবসায়ীরা সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চোরাচালান বৃদ্ধির ফলে মিয়ানমারে পণ্য রফতানি কম হচ্ছে। তাছাড়া মিয়ানমারে বিভিন্ন সমস্যার কারণে সীমান্ত বাণিজ্যে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। দু’দেশের সীমান্তে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ হলে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবসা প্রসারতা লাভ করছে। বর্তমানে রফতাণিতে নতুন পণ্যের সংখ্যা বাড়ছে। বাণিজ্যের বিশাল ঘাটতি দূর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সীমান্ত বাণিজ্যে বর্তমান অবস্থা বলবত থাকলে ব্যবসায় গতি ফিরে আসবে।ৃ