ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢেউ উঠছে মহাবিশ্বের কাঠামোয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ নভেম্বর ২০১৫

ঢেউ উঠছে মহাবিশ্বের কাঠামোয়

জাফর ওয়াজেদ জ্যোর্তিবিজ্ঞানী কিপথর্ন যখন রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন, তখন গ্রহ, নক্ষত্র বা নীহারিকাপুঞ্জÑযা খালি চোখে দেখা যায় তা নিয়ে খুব একটু ভাবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অথবা ক্যালটেকের এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীকে আকর্ষণ করে সেই জিনিস, যা দেখা যায় না বা অনুভব করা যায় না। আমাদের চোখে যা অসীম শূন্যতা তা কিপথর্নের দৃষ্টিতে অন্তহীন মহাবিশ্বের পশমি গালিচার একটি প্রান্ত। দীর্ঘ অব্যবহার ও অযতেœর ফলে যা দুমড়ে মুচড়ে কুঁচকে গেছে। মহাজাতিক বস্তুগুলো এই দুমড়ানো গালিচায় বয়ে চলে নানা ওঠা-নামায়। ঠিক যেমনটা নিশ্চুপ ও স্থির ঝিলের জলে ঢিল ছুঁড়লে উঠে যায় ছোট ছোট তরঙ্গ। কিপথর্ণের কথায় এই আঁকাবাঁকা আঁচলটি হলো ডধৎঢ়বফ ঝরফব ড়ভ ডরহহবৎংব . গত চার দশক ধরে থর্ণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে এই বিজ্ঞানীর কাছে হাতে কলমে গবেষণায় হাত পাকিয়েছেন কমবেশী জনা পঞ্চাশেক পদার্থবিদ। এদের মধ্যে অনেকেই পেয়েছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। কিপথর্ন উদ্ভাবিত ‘মহাশূন্যের প্রান্ত ও সময়ের অবস্থা’ শীর্ষক বিমূর্ত ধারণাটিকে বাস্তবের মাটিতে গেঁথে এক আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান করে চলেছেন তারা। ১৯১৮ সালে এই বিমূর্ত ধারণার প্রবর্তন করেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন। তার মত ছিল যে, মহাবিশ্বের অতীব ঘন বস্তুগুলোর। (যেমন ব্ল্যাকহোল) সংঘর্ষের ফলে সময় ও শূন্যতা (স্পেস এ্যান্ড টাইম) দুমড়ে মুচড়ে যায়। আর সৃষ্টি হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। থর্ণের মতে, ‘এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উদ্ভব হয় মহাবিশ্বের আদিমতম অবস্থায়। সেই তরঙ্গের রেশ আজও রয়ে গেছে আর তার আভাস আজও খুঁজে পাওয়া সম্ভব।’ প্রথম ও আদি এই শক্তির আভাসের খোঁজে থর্নের নেতৃত্বে পদার্থবিজ্ঞানীরা গড়ে তুলেছেন এক অতিকায় আড়াই মাইলব্যাপী যন্ত্র। যার নাম লেসার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি বা লাইগো। ১৯৮৯ সালের গোড়া থেকে ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ওয়াশিংটন ও লুইসিয়ান রাজ্যে তৈরি হয় এই সন্ধানযন্ত্র। এই যন্ত্রে বিশাল বিশাল আয়নায় ইনফ্রারেড লেসার প্রতিফলতি করে নক্ষত্রের সংঘর্ষ ও ব্ল্যাক হোলের কম্পন মাপার চেষ্টা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বোস সেন্টারের জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী ও থর্ণের প্রাক্তন ছাত্র সন্দীপ কুমার চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব খুঁজে পেলে শুধু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বটির সত্যতা যাচাই হবে না। উপরন্তু মহাবিশ্বের জন্মলগ্নের নানা রহস্য উন্মোচন হবে। আমরা জানতে পারব দু’টি ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষের কী পরিণতি হয়। জানা যাবে কীভাবে নীহারিক্ষপুঞ্জের মতো অতিকায় মহাজাগতিক বস্তুগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল।’ লাইগো দীর্ঘ ২৫ বছরেও খুঁজে পায়নি কাক্সিক্ষত সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। মার্কিন করদাতার অর্থে পুষ্ট এই বৃহৎ কর্মকা- আজও নিস্ফলা। স্বভাবতই এই গবেষণা বহু বিজ্ঞান প্রশাসকের রোষানলে পড়েছে আজ। বহু পদার্থবিদও লাইগো আলেয়ার পিছনে ছুটে চলেছে। অপচয় হচ্ছে লাখ লাখ ডলার। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু জরুরী ও বাস্তবসম্মত গবেষণা। কিপথর্ন ও তার সহ গবেষকরা এই অভিযোগকে খুব একটা আমল দিতে চান না। তাদের আশা অচিরেই তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নাগাল পাবেন না। তার কথা,‘ আসলে পরীক্ষাটি অত্যন্ত দুরূহ। এতে আমরা অতি বৃহৎ এমন দুটি আয়না রেখেছি, যেগুলোর ওজন চল্লিশ কিলোগ্রামেরও বেশি। এগুলোতে প্রতিফলতি হয় আলো। দু’টি বিন্দুতে দশ হাজার ভাগের এক ভাগ ফার্মির পার্থক্য নিরূপণ করতে হয়।’ কিন্তু এই ক্ষুদ্রাতিক্ষত্র কম্পনের মাপ করা খুব কঠিন কাজ। রেলগাড়ির সংঘর্ষ বা ৩০ ফুট দূরে কোন মানুষের লাফালাফি-এই যন্ত্রের কাছে ভূমিকম্পের শামিল। এই দুমদাম শব্দ মূল মহাকষীয় তরঙ্গ যাচাইয়ের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্রুটি দূর করতে যন্ত্রটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যেখানে সাবেজি ‘লাইগো’ দশ বছরে একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান করতে সক্ষম। নব কলবরে তা বছরে বারোটি কম্পন ধরতে পারবে। শুধু তাই নয়। লাইগোকে জুড়ে দেয়া হবে ‘লাইমা’ তথা লোপার ইন্টারফেরোমিটার স্পেস এ্যান্টেনার সঙ্গে। যা মহাকাশে উপগ্রহে ভেসে থাকা সন্ধানযন্ত্র সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে এই তরঙ্গ খুঁজে চলেছে। চলতি ২০১৫ সালে এই কাজ সম্পর্ণ হলে কয়েক লাখ কিলোমিটার ব্যবধানের আয়নাগুলো অনায়াসে মহাকর্ষীয় আদিম তরঙ্গের আঁচ পেয়ে যাবে। আর তখনই সত্যি হবে কিপথর্ণের স্বপ্ন।
×