ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রীতা রায়

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’-আমেরিকাবাসীর প্রাণের উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৬ নভেম্বর ২০১৫

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’-আমেরিকাবাসীর প্রাণের উৎসব

সারা উত্তর আমেরিকায় আজ ধুমধামের সঙ্গে পালিত হচ্ছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসব। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। কয়েক শতক ধরেই নবেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আমেরিকায় মহাসমারোহ থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উদযাপিত হয়, এ বছরের ২৮ নবেম্বর, মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসব। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসবের মূল সুরে আছে, পরিবার, প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবসহ সকলে একত্রিত হয়ে জীবনের প্রতিটি সাফল্য, দেশ ও জাতির প্রতিটি সাফল্যের জন্য ইশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা। উৎসব উদযাপনে এদেশে কখনও কারও ক্লান্তি নেই, উপলক্ষ ছাড়াই এর পার্টি করে থাকে, আর উপলক্ষ হলে তো কথাই নেই। সাধারণ আমেরিকানদের অনেকেই জানে না ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ নামক এ জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব কবে থেকে শুরু হয়েছে, কেনই বা উৎসবটির নাম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে!’ তারা শুধু জানে, ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হচ্ছে টার্কি উৎসব। ময়ূরের মতো দেখতে টার্কির রোস্ট দিয়ে বিশাল ভূরিভোজ আয়োজন এবং পারিবারিক মিলনমেলা। ভূরিভোজের তালিকায় থাকে টার্কি রোস্ট, ক্র্যানবেরি সস, আলুর ক্যান্ডি, স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো এবং ঐতিহ্যবাহী পামকিন পাই। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসবের সূচনা ১৬২০ সালের আগস্ট মাসে ‘মে ফ্লাওয়ার নামের ১০৮ টন ওজনবাহী এক জাহাজ ১০২ জন যাত্রী নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউথ হ্যাম্পটন থেকে যাত্রা করে। যাত্রীদের সকলেই ছিল তীর্থযাত্রী, যাদেরকে ইংরেজীতে ‘পিলগ্রিম’ বলা হয়। ইংল্যান্ডে বসবাসকালীন স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করায় তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হতো। তাই নির্বিঘেœ, একাগ্রচিত্ত ঈশ্বরের উপাসনা করা যায়, এমন একটি আশ্রয়ের সন্ধানে তারা বের হয়। তাদের প্রাথমিক গন্তব্য ছিল ভার্জিনিয়া কোস্ট, যেখানে আরও পিলগ্রিমের বসবাস ছিল। যাত্রা শুরুর দুই তিন মাস পর ‘মে ফ্লাওয়ার’ আমেরিকার মেসাচুসেটস বে-তে এসে পৌঁছে। এত দীর্ঘযাত্রার উপযোগী পোশাক পরিচ্ছদ, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য মে ফ্লাওয়ারে মজুদ ছিল না। ফলে যাত্রীদের অনেকেই বৈরি আবহাওয়ায়, অর্ধাহারে-অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বেশকিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়। নতুন স্থানে পৌঁছে শীতের তীব্রতায় বাকি সকলেই অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে জাহাজ মেসাচুসেটসেই যাত্রা বিরতি করে। যাত্রীদের সকলেই জাহাজ থেকে তীরে এসে নামে। তাদের আর ভার্জিনিয়া কোস্টে পৌঁছানো হয়নি, মেসাচুসেটসেই ওরা প্লিমথ কলোনি গড়ে তোলে। শুরু হয় মুক্ত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার উদ্যোগ। শুরুতে তাদের অনেক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, শীতের তীব্রতায় প্রতিদিনই দুই একজনের জীবন সঙ্কট দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ মারাও যায়। শীত পেরিয়ে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে প্রাণে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। তারা ধীরে ধীরে ঘরবাড়ি বানাতে শুরু করে, আশপাশের স্থানীয় ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা, উপজাতিদের সাহায্যে চাষবাস করাসহ বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দেয়। উপজাতীদের সঙ্গে উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময় প্রথা চালু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্লিমথ কলোনি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। ১৬২১ সালের নবেম্বর মাসে প্লিমথবাসী প্রথমবারের মতো নিজেদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলে। ফসলের মধ্যে ভুট্টার ফলন এত বেশি ভাল হয়েছিল যে তৎকালীন গবর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড এই উপলক্ষে সমস্ত ইন্ডিয়ান উপজাতি এবং প্লিমথ কলোনিবাসীদের সৌজন্যে ‘ফিস্টি’ আয়োজন করেন। ফিস্টির দিনটিকে সকলে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করে। সকলেই কৃতজ্ঞচিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়, কারণ ঈশ্বরের কৃপায় তারা বেঁচে আছে, প্রভুর দয়ায় তাদের সকলের মধ্যে এক্য গড়ে উঠেছে , পতিত বনভূমিকে সকলে মিলে বাসযোগ্য কলোনি হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে, ঈশ্বর কৃপা করেছেন বলেই উৎপাদিত ফসলে তাদের গোলা ভরে উঠেছে, ফসলের ফলন এত বেশি হয়েছে যে, আগামী শীত কেটে যাবে কোন খাদ্য ঘাটতি ছাড়া। ঈশ্বরের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষে নিজেদের মধ্যে ধন্যবাদ বিনিময় হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়, সকলে মিলে আনন্দ ফুর্তিতে কাটিয়ে দেয় একটি দিন। পরস্পর পরস্পরে ধন্যবাদ বিনিময়ের সেইদিন থেকেই অনুষ্ঠানটি আমেরিকার সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্লিমথ কলোনিবাসীর দেখাদেখি ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপনের এই রীতি অন্যান্য কলোনিবাসীদের মাঝে প্রচলিত হতে থাকে। তবে বছরের নির্দিষ্ট দিনে তা পালিত হতো না। কলোনিবাসীদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী তারা বছরের একটি দিন ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপন করত। সরকারীভাবে সর্ব প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপিত হয়েছিল নিউইয়র্কে, ১৮১৭ সালে। এরপর থেকে প্রতি বছর অন্যান্য স্টেটেও উৎসবটি পালিত হতে থাকে। প্রথমদিকে নিউইয়র্ক এবং অন্যন্য স্টেটে দিনটি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষিত ছিল। পরবর্তীতে সকল স্টেট থেকে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’কে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার পক্ষে জোর দাবি উঠতে থাকে। ১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারি রাইম ‘মেরি হ্যাড এ্যা লিটল ল্যাম্ব’ রচয়িতা সারাহ যোসেফা উদ্যোগ নেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি পত্র-পত্রিকায় আর্টিক্যাল এডিটোরিয়াল লিখাসহ এই আবেদনের সপক্ষে প্রচুর চিঠিপত্র গবর্নর, সিনেটর প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদদের কাছে পাঠিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, সারাহ যোসেফের আবেদন খুব গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন এবং ‘সিভিল ওয়ার’ চলাকালীন সময়েই জনগণের উদ্দেশ্যে আবেদনমূলক ঘোষণা দেন সকলেই যেন পরম করুণমায় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানায়, ‘হে ঈশ্বর! তোমার স্নেহের পরশ, অপার করুণা তুমি তাদের উপর বর্ষণ কর যারা গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে নারী স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান পিতৃহারা হয়েছে, যা ক্ষতি সমস্ত জাতির হয়েছে, সমস্ত ক্ষতি যেন দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। জীবিত সকলের যেন মঙ্গল হয়।’ একই বছর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নবেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসাবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা শুরু হয়। ‘গ্রেট ডিপ্রেশান’ হিসাবে পরিচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট রিটেল সেল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন এবং সেই থেকে শেষ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে নবেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’!! আমেরিকান উৎসবগুলোর মধ্যে ক্রিসমাস উৎসবের পরেই থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উৎসবের স্থান। অতি গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনটি পরিবারের সকলে মিলে কাটাতে পছন্দ করে। দুপুরে পরিবারের সকলে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে, দুপুরের খাবার, কিন্তু বলা হয় ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনার’। থ্যাঙ্কস গিভিং ডে উপলক্ষে টিভিতে ফুটবল গেম, থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেড প্রচারিত হয়ে থাকে। থ্যাঙ্কস গিভিং প্যারেডে পিলগ্রিম (ব্রিটিশ অরিজিন, যারা ধর্মীয় তীর্থযাত্রী হিসাবে সমুদ্রযাত্রা করেছিল এবং আমেরিকার মেসাচুসেটসে প্লিমথ কলোনি গড়েছিল) এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের ডিস্পলে দেখানো হয়ে থাকে। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটির নাম ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’। বৃহস্পতিবার রাত বারোটার পর থেকে এই সেল শুরু হয়, শুক্রবার কাক ভোরে তা শেষও হয়ে যায়। আমেরিকার প্রতিটি রিটেল স্টোরে অতি সুলভমূল্যে আকর্ষণীয় পণ্য বিক্রয় করা হয়। পণ্য সরবরাহ সীমিত থাকে, বিক্রয় সময়ও থাকে নির্দিষ্ট। তাই ক্রেতাদের ভিড় হয় অনিয়ন্ত্রিত। প্রায়ই আমেরিকার বিভিন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। প্রতিবছর ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল’ আমেরিকার অর্থনীতির সূচককাঁটা ঘুরিয়ে দেয়। এভাবেই ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ধর্মীয়ভাবে গাম্ভীর্য অপেক্ষা বাণিজ্যিক দিকটাই বেশি প্রকাশিত হয়ে ওঠে। যদিও অধিকাংশ আমেরিকাবাসীর কাছেই ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা বাণিজ্যিক জৌলুসটাই বেশি নজরে আসে, তারপরেও শুধু আমেরিকা বা কানাডাতে দিনটি উদযাপিত না হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা পালিত হতে পারে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তো প্রতি নিয়তই দেয়া উচিত এমন সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বলে, ধন্যবাদ দেয়া উচিত, এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য, আমাদের সৃষ্টি করেছেন বলে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীটাকে নানা ধনসম্পদে ভরিয়ে রেখেছেন বলে। আমাদের সকলেরই তো মে ফ্লাওয়ার এর যাত্রী, পিলগ্রিমদের মতোই পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর কথা, শত্রু নয়, বন্ধু নীতিতে চলার কথা, তা না করে আধুনিক বিশ্বে মানুষ হয়ে উঠছে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর অমানবিক। প্রতিদিন নিষ্ঠুর গোলার আঘাতে হত্যা করে চলেছে অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশু। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ শুধুমাত্র প্রতীকী দিবস হিসাবে পালিত না হয়ে আক্ষরিক অর্থেই পারস্পরিক বন্ধুত্ব ভাল কাজের স্বীকৃতি, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও উদারতায় পরিপূর্ণ হোক। মানুষ যুদ্ধ বিগ্রহ ভুলে, হানাহানি, মারামারি বন্ধ করে, প্রতিবেশী, প্রতিবেশী দেশ তথা সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব অথবা সন্ধি করা কথা ভাবুক, তবেই ঈশ্বরও আমাদের জীবনে তাঁর করুণা বর্ষণ করবেন। ঈশ্বরের করুণায় সিক্ত হয়ে আমরাও প্রতিদিন অথবা প্রতি মাস অথবা বছরের একটি দিন, ঈশ্বরের জয়গান করতে পারি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে পারি আমাদের প্রতি অবারিত করুণা বর্ষণের জন্য। আজকের দিনটি হোক ঈশ্বর বন্দনায় নিবেদিত। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’- দিনটি হোক সকলের, পৃথিবী হয়ে উঠুক বাসযোগ্য।
×