ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৮ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

কৈশোর থেকে উত্তরণ (৭ নবেম্বরের পর) ১৯৪৭ সালে সিলেটে ছাত্র নেতৃত্ব সহসা শূন্যতায় ভুগতে থাকে। বিভাগ-পূর্বকালে যারা নেতা ছিলেন তারা প্রায় সবাই আই.এ, বি.এ পাস করে ঢাকায় পাড়ি দিলেন। তসাদ্দুক আহমদ, এটি মসউদ, আবদুস সামাদ, ফজলুর রহমান, লুৎফুর রহমান জায়গীরদার, এমদাদুল হক চৌধুরী এরা সবাই সিলেটের অঙ্গনে আর থাকলেন না। মুসলিম লীগ নেতাদেরও জোশ তেমন অবশিষ্ট ছিল না। এ সময় ঢাকায় অধ্যাপক আবুল কাসেম তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠা করলেন ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ইসলামপন্থী প্রগতিবাদী গোষ্ঠী হিসেবে তারা অনেক নেতাকে আকর্ষণ করেন। শাহেদ আলি, দেওয়ান ওহিদুর রেজা এতে যোগ দেন। সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এই শূন্যতায় সৃষ্টি হয় সিলেট শিক্ষা কমিটি, যার আহ্বায়ক হই আমি। এই কমিটিও পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে হয় ছাত্র ইউনিয়নের পথপ্রদর্শক। আমি ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে এর নেতৃত্ব দেন নাসির চৌধুরী, খন্দকার রুহুল কুদ্দুস, তারা মিয়া প্রমুখ। এই প্রতিষ্ঠানই ১৯৫৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হয় ঢাকার ছাত্র সম্মেলনে। ১৯৪৮ সালে সিলেটে দু’জন কেন্দ্রীয় বড় নেতা ভ্রমণে আসেন। ১১ জানুয়ারিতে আসেন কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী সীমান্ত প্রদেশের আবদুর রব নিশতার। একই বছরে ২৬ নবেম্বর সরকারী সফরে আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং বেগম রানা লিয়াকত আলী। ‘মুকুলফৌজ’-এর তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আমরা একটি গার্ড অব অনার প্রদান করি। পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও ১৯৪৮ সালে সম্ভবত জুলাই মাসে এক সফরে আসেন। এরা সফরে আসলে তাদের জন্য অভ্যর্থনা সভা হতো এবং সেখানে আমি প্রায়ই ‘মুকুলমেলা’র তরফ থেকে লিখিত স্বাগত বক্তব্য রাখতাম। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ ছিল আমার জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেই সময়ে একদিকে যেমন অনেক লেখাপড়া করি, অন্যদিকে তেমনি প্রবন্ধ রচনা, সাহিত্য সভা এসব বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী হই। প্রবন্ধ রচনার বিষয়াবলী ছিল হযরত মুহাম্মদ (স.), কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি ইকবাল। এর ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় বিখ্যাত ব্যক্তি সম্বন্ধে লেখা হতো এবং হয়তো গল্প লেখারও উদ্যোগ থাকত। তখন ছাত্ররা যারা লেখালেখি করত তারা সকলেই কবিতা লিখত। আমি কোনদিন একটি কবিতাও লিখতে পারিনি অথবা লেখার চেষ্টাও করিনি। এ সময় কয়েকজন শিক্ষক আমার জীবনে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাদের একজন সম্বন্ধে আগেই বলেছি। তিনি ছিলেন দ্বীগেন্দ্র বাবু এবং তারই উৎসাহে আমি বঙ্কিম চন্দ্রের সমগ্র রচনাবলী পড়তে শুরু করি। শরৎচন্দ্র অবশ্য তখনও আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। আমাদের সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মোটামুটিভাবে সারাজীবনই একই বিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিলেন। উপরের দিকে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে কিছু বদলি হতো। আমি বিদ্যালয়ে ভর্তি যখন হলাম তখন খান সাহেব মুফিজুর রহমান ছিলেন প্রধান শিক্ষক এবং তিনি এ পদে বহাল ছিলেন ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। তারপর বেশ ক’জন প্রধান শিক্ষক স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেন। আরশাদ আলী ১৯৪৫-এ বছর দেড়েক থেকে ১৯৪৬ সালে অবসর নেন। তারপর প্রধান শিক্ষক শ্রীশ গুপ্ত এক বছরের কম সময় এ পদে ছিলেন। পরবর্তী প্রধান শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র কর মনে হয় সারাটি সময়ই সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং প্রধান শিক্ষক হিসেবে মাত্র দু’বছর বহাল থাকেন। দেশ বিভাগের পরপরই আসলেন আবদুল গফুর চৌধুরী এবং তিনি অবসরে যান ৪ বছর পর ১৯৫১ সালে। আবদুল গফুর সাহেব ছিলেন খুবই পরিচিত জন। তিনি প্রায় দশ বছর আমার আব্বার এক রকম অভিভাবক ছিলেন, সে সম্বন্ধে আমি আগেই বলেছি। তিনি আমার অঙ্কে দুর্বলতা নিয়ে এত চিন্তিত ছিলেন যে, প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে সহকারী প্রধান শিক্ষক চন্দ্র কুমার পাল তারই পরামর্শে আমাকে দেড়টি মাস প্রায় প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক একান্তে পড়াতেন। তার ছেলে নির্মলেন্দু পাল প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত যে, তার বাবা আমার সঙ্গে এত সময় কাটান কেন। নির্মলেন্দু খুব ভাল ছাত্র ছিল এবং ১৯৫৩ সালে সে সারা প্রদেশে আই এস সি (বর্তমান এইচএসসি বিজ্ঞান) পরীক্ষায় প্রথম হয়। আবদুল গফুর চৌধুরী সাহেব আমাকে একজন ভাল ছাত্র হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেন। যদিও আমার ক্লাস পরীক্ষার ফলাফল তেমন উত্তম ছিল না। কোন পরীক্ষায় আমি তেমন ভাল করিনি; কিন্তু গফুর সাহেব তাতেও নিরাশ হলেন না। তিনি আমার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ও নিবেদন অটুট রাখতে সচেষ্ট থাকেন। বলা যায় যে, আমি আমার সমসাময়িকদের মধ্যে সম্ভবত বাস্তব জীবনে সবচেয়ে বেশি ভাল করেছি এবং গফুর সাহেব সব সময়ই আমার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছেন তাতে খুশি হয়েছেন এবং আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বলতেই হবে যে, তিনি তার ছাত্রটিকে ঠিকমতোই পরখ করেছিলেন। গফুর সাহেব তার ছাত্রদের জন্য নিঃস্বার্থ সেবা এবং গভীর উৎসাহ দিতে সবসময়ই অগ্রসর ছিলেন। আল্লাহতায়ালা তাকেও ভাল সন্তানভাগ্য দিয়েছিলেন। তার জ্যেষ্ঠ সন্তান মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির আসনটি অলঙ্কৃত করেন। তার দ্বিতীয় ছেলে নুরুল আমিন চৌধুরী কলেজের লেখাপড়া শেষ করেই আমেরিকায় চলে যান এবং সেখানে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি স্যার জাফরউল্লাহর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অতঃপর তিনি নিউইয়র্ক থেকে এমবিএ করেন। বর্তমানে তিনি টেক্সাসবাসী এবং সেখানে একটি বড় চেইন গ্রোসারি বিপণন স্টোরের ক্রয় বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমার বিদ্যালয় জীবনে আট বছরে যে শিক্ষকরা ছিলেন তাদের প্রায় চল্লিশজনের নাম আমার এখনও মনে আছে। ইতোমধ্যে পাঁচজন প্রধান শিক্ষক ও একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকের নাম নিয়েছি। আরও দু’জন সহকারী প্রধান শিক্ষকও আমাদের পাঠদান করেন। তারা ছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণীর শ্রেণী-শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম সম্বন্ধে বলেছি। তাছাড়া যাদের মনে পড়ে তাদের মধ্যে বিশেষ কারণে দ্বিগেন্দ্র বাবুর নাম নিয়েছি। আর একজন শিক্ষক যিনি টুপি পরতে হুকুম করেন সেই আশরাফ আলীরও নাম করেছি। অন্য যাদের নাম বলতে পারি তারা হলেন ভূগোল ও বাংলা শিক্ষক ইয়াকুব আলী, যার বেতকে সবাই ভয় করত, তবে তিনি ছিলেন খুবই স্নেহময়। আজিজ বখত চৌধুরীর কথা আগেই বলেছি। আবদুল গফুর ছিলেন বিখ্যাত অঙ্ক শিক্ষক। রোহিনী কুমার গোস্বামী, প-িত হারাধন চক্রবর্তী, প্রিয়ংবদ বাবু, ভুদেব বাবু, সোনামণি সিংহ, ফখরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইবরাহিম আলী, আফতাবুর রাজা চৌধুরী, দ্বারকা বাবু, প্রমোদা বাবু, মুইনুদ্দিন চৌধুরী এদের মনে পড়ে। প-িত হারাধন চক্রবর্তী অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি বাংলা পড়াতেন। তার ক্লাসে দুষ্ট ছেলেদের তিনি ছোটখাটো শাস্তি দিতেন, দাঁড়িয়ে থাকা বা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা। দুষ্টুমি তাতেও প্রশমিত না হলে তিনি তার হাতের বেতটি ব্যবহার করতেন। কিন্তু বেতের ব্যবহারটি ছিল এমন যে, সেটা যাতে গায়ে না লাগে তিনি সে সুযোগটি নিতেন এবং তার মারটি মোটামুটিভাবে শুধু কাপড়ের ওপরেই হতো। সোনামণি সিংহ ছিলেন মণিপুরী গোষ্ঠীর সদস্য। চলবে...
×