ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটের শিশু রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যার বিচারের আজ রায়

‘ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই’ মায়ের এ আকুতি পূরণ হবে কি!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ নভেম্বর ২০১৫

‘ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই’ মায়ের এ আকুতি পূরণ হবে কি!

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সিলেটের শিশু রাজন। ধারালো ছুরির আঘাত বা বন্দুকের গুলিতে নয়, তাকে হত্যা করা হয় তিলে তিলে, অনবরত রডের আঘাতে। কী নির্মম হত্যা। খুলনার শিশু রাকিবকে হত্যার ঘটনায়ও রয়েছে ভয়াবহতা। তাকে হত্যা করা হয়েছে পায়ুপথে কম্প্রেসারের হাওয়া দিয়ে। কী নির্মমতা! এইতো সেদিনের ঘটনা। রাজন ও রাকিবের সেই আর্তনাদ এখনও শুনতে পায় দেশের মানুষ। বিশ্বব্যাপী আলোচিত, বর্বরোচিত, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলা দুটির রায় আজ। রাজন-রাকিবের পরিবারের সঙ্গে গোটা জাতির দাবি- ফাঁসি হোক ওই মানুষরূপী পশুদের। আজ রবিবার সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত ঘোষণা করবে শিশু রাজন হত্যা মামলার রায় এবং শিশু রাকিব হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করবে খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালত। বিচার শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যেই রায় হচ্ছে মামলা দুটির। রাজন হত্যা গত ৮ জুলাই শহরতলীর কুমারগাঁও এলাকায় ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পৈশাচিক কায়দায় নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাজনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভ নিন্দা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে বিশ্ববিবেক। উত্তাল হয়ে ওঠে সিলেট। হত্যাকা-ের দৃশ্যসংবলিত ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দাবি ওঠে ওই নরপশুদের বিচারের। পরে জাগ্রত জনতা রাজন হত্যাকারীদের একে একে আটক করে তুলে দেয় পুলিশের হাতে। প্রধান আসামি বিদেশে পালিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। হত্যাকা-ের ৪ মাসের মধ্যেই মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিদিন প্রহর গুনছেন রাজনের পরিবারসহ অগণিত মানুষ। এ বিচার চলাকালে সাধারণ মানুষ মামলার খোঁজ রেখেছেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। শুনানির দিন আদালতপাড়ায় ছুটে এসেছেন তারা। যারা আসতে পারেননি তারাও চোখ রেখেছেন গণমাধ্যমগুলোতে। খুনের ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজনের বাড়ি বাদেআলী গ্রামে মানুষের ছুটে আসা অব্যাহত রয়েছে। সবাই সান্ত¡না সহমর্মিতা প্রকাশ করছেন, কেউবা রাজনের পরিবারের প্রতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহায়তার হাত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও রাজনের পরিবারকে অর্থ সাহায্য দেয়া হয়েছে। রাজন হত্যার পরপরই খুনীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে সবাই। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম রাজন হত্যা ও হত্যাপরবর্তী সকল ঘটনা গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। সাধারণ মানুষের আলোচনায় চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। খুনীদের পার পাওয়ার সুযোগ নেই। রাজন হত্যার ঘটনা দেশ-বিদেশে অসংখ্য মানুষ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছেন। সাক্ষীদের জবানবন্দীতেও বেরিয়ে এসেছে হত্যাকা-ের বর্ণনা। এবার আদালতের রায়। সিলেট আদালতের পিপি এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। রয়েছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী। এজন্য আসামিদের মৃত্যুদ-ই আমার প্রত্যাশা। মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি এ্যাডভোকট মফুর আলী বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথ হয়েছে। আমাদের দাবি সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি। রাজনের বাবা আজিজুর রহমান বলেন, আমার নিরপরাধ নিষ্পাপ ছেলেকে ওরা কিভাবে হত্যা করেছে তা বাংলাদেশসহ বিশে^র মানুষ দেখেছে। আমি চাই প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। তিনি বলেন, আমাদের মতো আর যেন কোন বাবা-মায়ের কোল এমনভাবে খালি না হয়। তিনি আরও বলেন, আমার সন্তান তো এমন কোন অপরাধ করেনি যে তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে। আমার ছেলে অপরাধ করলে তো তার জন্য আইন ছিল, বিচার ছিল। কামরুলসহ সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের রায়ই আমার দাবি। রাজনের বাবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সকল সংবাদিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা সকলে দিনরাত পরিশ্রম করে সহযোগিতা করেছেন বলেই এত দ্রুত আমার ছেলে হত্যার বিচার হচ্ছে। ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান রাজনের মা লুবনা বেগমও। তিনি বলেন, ছেলে খুন হওয়ার পর অনেকে অনেকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তবে এর মাধ্যমে তো আর আমার ছেলেকে ফিরে পাব না। আমি বিচার চাই। রাজন হত্যা মামলার রায়ের বিষয়ে সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করছি। রাজন হত্যা মামলার বিচারকাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি একটি ইতিবাচক দিক। আমরা শুধু এ হত্যাকা- নয়, অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রেও একই উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি। ত্বকী, শিশু সাঈদ হত্যা ও নুর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার বেলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেই এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। জাসদ সভাপতি লোকমান রাজন হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, এই রায় অনুকরণীয় হোক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটা প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এ বিচার অন্যায়কারীদের নিরুৎসাহিত করবে। ব্লাস্টের কো-অর্ডিনেটর চৌধুরী ইরফানুজ্জামান রাজন হত্যার বিচারকাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, সঠিক সাজার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক, যা থেকে অন্যরা এ অপরাধ থেকে বিরত থাকে। বাদেআলী গ্রামের মেম্বার ও জামে মসজিদের মুতওয়াল্লী আব্দুর জহির বলেন, আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজন হত্যার বিষয়ে আমার একটাই দাবি থাকবে- এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকল দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেয়া হোক। এখন এ দাবি শুধু আমার নয়, এই এলাকার সকল মানুষের ও দেশবাসীর। মাদক ও যৌতুকবিরোধী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন চিরন্তনের সভাপতি দিলদার মোঃ শাহজাহান বলেন, আলোচিত এ হত্যাকা-ের রায়ে ফাঁসি হলে সমাজের মানুষের যে অধপতন হয়েছে তা কিছুটা হলেও বোধশক্তি হবে। বাংলাদেশ যুব মৈত্রী সিলেট মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আহমেদ বলেন, আমরা রাজন হত্যাকা-ে দোষীদের ফাঁসি দেখতে চাই। এতে অন্যরা অপরাধে সাহস পাবে না । গত ১৬ আগস্ট ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। ২২ সেপ্টেম্বর মামলার অভিযোগ গঠন করেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ৯ কার্যদিবসে মামলায় ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। বিচার শুরুর এক মাসের মধ্যে আলোচিত এ মামলার রায় প্রদানের তারিখ নির্ধারিত হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলার ১৩ আসামির মধ্যে দু’জন পলাতক ও ১১ জন কারাগারে রয়েছেন। প্রধান আসামি কামরুল ছাড়াও রাজন হত্যা মামলার বাকি আসামিরা হলেন- মুহিদ আলম, আলী হায়দার, শামীম আহমদ, পাভেল আহমদ, ময়না চৌকিদার, রুহুল আমিন, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল, দুলাল আহমদ, নুর মিয়া, ফিরোজ মিয়া, আছমত উল্লাহ ও আয়াজ আলী। এর মধ্যে পাভেল ও শামীম পলাতক। রাকিব হত্যা ॥ শিশু রাকিব হত্যার পর খুলনার সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হত্যাকারীদের শাস্তি দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচী পালন করে। প্রশাসন, পুলিশসহ সকল পক্ষগুলোই রাকিব হত্যা মামলার ন্যায়বিচার ও দ্রুতবিচার চেয়েছে। আজ রবিবার রায় ঘোষণা করা হবে। রায় ঘোষণার আগমুহূর্তে খুলনাসহ দেশবাসীর মানুষের মধ্যে চলছে জল্পনা-কল্পনা। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি স্বল্প সময়ে নিষ্পত্তির বিষয়টিও স্থানীয়দের আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। রায় নিয়ে রাকিবের পরিবারের সঙ্গে খুলনাবাসীরও একই প্রত্যাশা- খুনীদের ফাঁসি হবে। মামলার বাদী রাকিবের বাবা নুরুল আলম বলেন, আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই। রাকিবের মা লাকি বেগমও ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান। বাদীপক্ষের আইনজীবী ও বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আশা করছি আসামিরা সর্বোচ্চ দ-ে দ-িত হবে। তিনি জানান, কোন হত্যা মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিশু রাকিব হত্যা মামলার রায় হবে প্রথম ঘটনা। রায় ঘোষণার জন্য আদালতে মাত্র ১০ কার্য দিবস লেগেছে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিলম্বের কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর এক ধরনের অনীহা দেখা দিয়েছিল। রাকিব হত্যা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির কারণে বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন। জনউদ্যোগ খুলনার সভাপতি নাগরিক নেতা এ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা দ্রুত সময়ে শিশু রাকিব হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হতে যাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। যে কারণে সেøাগান উঠেছে বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না। এ অবস্থার মধ্যে শিশু রাকিব ও রাজন হত্যা মামলার রায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে হতে যাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, রাকিবের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে। গত ৩ আগস্ট বিকেলে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়া কম্প্রেসার মেশিনের পাইপের মুখ পায়ুপথে ঢুকিয়ে হাওয়া দিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রাকিবকে। তার অপরাধ ছিল এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগ দেয়া। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনতা টুটপাড়া কবরখানা এলাকার মোটরসাইকেল গ্যারেজ শরীফ মোটর্সের মালিক মোঃ শরীফ (৩০) ও তার কথিত চাচা মিন্টু খানকে (৩৫) গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে শরীফের মা বিউটি বেগমকেও পুলিশ গ্রেফতার করে। ঘটনার পরের দিন ৪ আগস্ট নিহত শিশুর বাবা নুরুল আলম ওই তিনজনকে আসামি করে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই কাজী মোস্তাক আহমেদ গত ২৫ আগস্ট এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। গত ৬ সেপ্টেম্বর মামলাটির বিচারকার্য শুরুর জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করা হয়। ৫ অক্টোবর আসামি শরীফ, মিন্টু মিয়া ও বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। মামলায় মোট ৩৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
×