ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় আর দূরে নয়

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৯ নভেম্বর ২০১৫

ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় আর দূরে নয়

বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর একটি হলো ম্যালেরিয়া। প্রতিবছর এ রোগে সারাবিশ্বে সাড়ে চার লাখ লোক মারা যাচ্ছে। ম্যালেরিয়ার প্রাথমিক আক্রমণে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আরও লাখ লাখ লোক দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। ম্যালেরিয়া সরাসরি ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও পরোক্ষভাবে মানুষের যে সম্ভাবনাময় ক্ষমতাকে ধ্বংস করে তাও বিশাল। গেটস ফাউন্ডেশন নামে একটি মার্কিন দাতব্য সংস্থার হিসাবে ম্যালেরিয়াকে নির্মূল করা গেলে ২০৪০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্ব ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সুফল লাভ করবে। আশার কথা, বিশ্বের বুক থেকে এই ভয়াবহ রোগটি নির্মূল হবার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক টিকা বের হবার পথে। সভ্যতার সেই উষালগ্ন থেকে ম্যালেরিয়ায় লোক প্রাণ হারিয়ে আসছে। ১৯০০ সালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এটা মহামারী আকার ধারণ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে ম্যালেরিয়ায় বছরে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে। ম্যালেরিয়া নির্মূলের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। ফলে পরবর্র্র্তী দশকে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু নাটকীয়ভাবে কমে আসে। তবে সেই কার্যক্রমের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে রোগটি আবার ফিরে আসে। ফলে আবার ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ শুরু হয় এবং তা সুফলও দিতে থাকে। ২০০০ সালে ম্যালেরিয়ায় সারাবিশ্বে মারা গিয়েছিল সাড়ে ৮ লাখ লোক। এখন সেটা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চলে, যেখানে এ রোগে ৯০ শতাংশ মৃত্যু ঘটে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে রোগ নিয়ন্ত্রণে উন্নততর ব্যবস্থার ফলে ২০০১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আফ্রিকায় ৩৯ লাখ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে। ম্যালেরিয়া সংক্রমিত মশার দংশন থেকে এ রোগের সূত্রপাত। দংশনের মধ্য দিয়ে সেই মশা সামান্য সংখ্যক পরজীবী জীবাণু মানুষের রক্তে ঢুকিয়ে দেয়। সারাবিশ্বে ৪০ প্রজাতির এনোফিলিস মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর ধারক বা হোস্ট হিসেবে কাজ করে। পরজীবী এই জীবাণুগুলো রক্ত প্রবাহের সঙ্গে লিভারে চলে যায় এবং সেখানে তাদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর এরা রক্তের লোহিত কণিকাগুলোকে সংক্রমিত করে সেখানে সংখ্যা বিস্তার করে চলে। জীবাণুগুলো রক্তকোষ ভেঙ্গে বেরিয়ে এলে ফ্লুর মতো লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এটা ঘটে মশার দংশনের এক থেকে চার সপ্তাহ পর। সংক্রমিত ব্যক্তিকে অন্যান্য মশা দংশন করলে সেগুলোর শরীরেও ঐ জীবাণু চলে যায়। ফলে এসব মশা সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তিও ম্যালেরিয়া জীবাণুতে সংক্রিত হয়। পাঁচ ধরনের ম্যালেরিয়ায় মানুষ ভুগে থাকে। তবে ম্যালেরিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মৃত্যুর জন্য দায়ী হলো প্লাসমোডিয়াম ফলসিপেরাম জীবাণু। ২০১৩ সালে আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চলে যে ৫ লাখ ২৮ হাজার লোক মারা গিয়েছিল তাদের কার্যত সবাই এই জীবাণুর শিকার। প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স নামে আরেক জীবাণু ভৌগোলিক দিক দিয়ে সবচেয়ে ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। সাহারা সন্নিহিত আফ্রিকার বাইরে বেশিরভাগ ম্যালেরিয়ার সংক্রমণের জন্য এই জীবাণু দায়ী। তবে এটা প্লাসমোডিয়াম ফলসিপেরামের মতো অত প্রাণঘাতী নয়। এই জীবাণু লিভারে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং রক্তে চলে এলে আবার ম্যালেরিয়া দেখা দিতে পারে। ঘন ঘন ম্যালেরিয়ায় ভুগলে রোগী দুর্বল হয়ে যায়। তখন অন্যান্য রোগে সহজে আক্রান্ত হতে পারে। অপর তিন শ্রেণীর ম্যালেরিয়ার লক্ষণ তেমন গুরুতর নয়। ম্যালেরিয়া দমনে প্রথম দুই মারাত্মক ধরনের জীবাণুর ওপরেই মূল দৃষ্টি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং পরে সেই মশা ও তাদের বহন করা জীবাণু ধ্বংস করা কঠিন। ম্যালেরিয়া জীবাণু সংক্রমিত ৮৫ শতাংশ ব্যক্তির দেহে কোন লক্ষণ দেখা যায় না এবং রোগটি দেখা দেয়ার আগে জীবাণুটি প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্রমিত হবার পর বছরের পর বছর কিংবা মাসের পর মাস সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। যে কারণে ম্যালেরিয়া দমন করা বেশ জটিল ব্যাপার। ম্যালেরিয়া জীবাণু নির্ণয় করতে ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম সব দেশে পাওয়া যায় না। স্বল্প মাত্রায় সংক্রমণ অনেক সময় ফিল্ড টেস্টে ধরা পড়ে না। ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট ও তার বাহক মশা দমন করা সমভাবে কঠিন। উভয়েই ওষুধ বা কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যথেষ্ট দক্ষ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বেশ কিছু দেশে মশা দমনে ডিডিটি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গিয়েছিল। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে এসেছিল। পরে ডিডিটির বিরুদ্ধে মশায় প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। আগে ম্যালেরিয়ার একটি অতি প্রচলিত ওষুধ ছিল ক্লোরোকুইন। পরে দেখা গেছে প্লাসমোডিয়াম ফলসিপেরাম এই ওষুধটির রেজিস্টেন্ট হয়ে গেছে। আবার এর উল্টোটাও হয়। মানুষও ম্যালেরিয়া রেজিস্টেন্ট হয়ে যায়। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় বার বার ম্যালেরিয়া জীবাণু সংক্রমিত হবার ফলে এই পরজীবীর বিরুদ্ধে আংশিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। তবে সেটা শিশুদের মধ্যে নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে। আবার যেখানে ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়ে গেছে সেখানে কালক্রমে মানুষের মধ্যে এই ইমিউনিটি হারিয়ে যায়। তখন আবার এ রোগ দেখা দেয় এবং তাতে সবাই আক্রান্ত হতে পারে। পি, ফলসিপেরামের কারণে ম্যালেরিয়া হয় এমন বেশিরভাগ দেশে ম্যালেরিয়ায় সর্বাধিক ব্যবহৃত চিকিৎসাটি হলো আর্টেমিসিনিন বেসড্ কম্বিনেশন থেরাপি বা সংক্ষেপে এসিটিএস। এতে ম্যালেরিয়ায় শিশু মৃত্যু ৯৬ শতাংশেরও বেশি কমানো সম্ভব হয়েছে। তবে এসিটিএস-এর বিরুদ্ধেও কোথাও কোথাও ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। তাই দেখা যায়, ম্যালেরিয়ার যত ওষুধ আছে প্রথম প্রথম তাতে কাজ দিলেও পরে আর কাজ দেয় না। ওদিকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বাহক মশা দমনে এখন চার ধরনের কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছেÑ ঘরে স্প্রে করে অথবা মশারিতে লাগিয়ে। বিশেষ করে কীটনাশক লাগানো মশারি হচ্ছে মশা দমনের অধিকতর কার্যকর ও বহুল ব্যবহৃত ব্যয় সাশ্রয়ী ব্যবস্থা। মশারিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের নাম পাইরেথ্রোয়েড। এটিসহ চার ধরনের কীটনাশকের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। ফলে ম্যালেরিয়ার বাহক মশা দমনের এসব ব্যবস্থা অকার্যকর হতে চলেছে। তবে সামগ্রিকভাবে ম্যালেরিয়া দমনের ব্যবস্থা যে কাজ দিচ্ছে না তা নয়। এতে বিপুল অর্থও অবশ্য ব্যয় হচ্ছে। ম্যালেরিয়া দমন কার্যক্রমে তহবিলের একক বৃহত্তম উৎস হলো গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিবি এ্যান্ড ম্যালেরিয়া। ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্লোবাল ফান্ড ম্যালেরিয়ার পেছনে ৮শ’ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তথাপি গেটস ফাউন্ডেশনের মতে, ম্যালেরিয়া নির্মূল করার পথে থাকতে হলে এখন থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, যে খরচটা বছরে পৌঁছাবে ৬শ’ কোটি ডলারে। ফাউন্ডেশনের হিসাবে এখন থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের মোট খরচ দাঁড়াবে ৯ হাজার থেকে ১২ হাজার কোটি ডলার। বিশাল অঙ্ক সন্দেহ নেই। কিন্তু এ থেকে প্রাপ্তিটা আসবে অনেক বেশি, যার অর্থমূল্য ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ম্যালেরিয়ার পিছনে মোট ব্যয়িত অর্থের কিছু অংশ এমন এমন ওষুধ উদ্ভাবনের পেছনেও ব্যয় হচ্ছে যার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া চিরতরে দূর হতে পারে। এর মধ্যে প্রতিরোধক টিকাও আছে। ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত ওষুধ আর্টেমিসিনিনের পরিপূরক হিসেবে আরও বেশ কিছু ওষুধ বের হবার পথে রয়েছে। তবে সেগুলো বাজারে আসতে আরও কয়েক বছর লাগবে। তেমনি প্রচলিত কীটনাশকগুলোর জায়গায় ৯ ধরনের নতুন কীটনাশক উদ্ভাবিত হবার পথে। তবে বাজারে আসতে কমপক্ষে ৩ বছর লাগবে। ভ্যানসিন বের করার সাধনা চলছে কয়েক দশক ধরে। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে হতে অবশেষে ধরা দিয়েছে সেই বহু সাধনার ভ্যাকসিন। গ্লাক্সো-স্মিথক্লাইন কোম্পানির উদ্ভাবন এই ভ্যাকসিন আরটিএসএস (এসআইসি) হচ্ছে প্রথম ভ্যাকসিন যা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার সফল স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায়। অর্থাৎ বাজারে এসে পড়ল বলে। আরটিএসএস কাজ করে। তবে খুব ভালভাবে এমন নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া আক্রমণের হার চার বছর সময়ের মধ্যে ৩৬ শতাংশ কমাতে পেরেছে। আরও দীর্ঘতর সময়ে এটা কেমন কাজ করবে তা এখনও অজানা। একটা আদর্শ ভ্যাকসিনের দুটি বৈশিষ্ট্য থাকবে। একটা হলো মানবদেহে সংক্রমণ থামাবে বা সংক্রমিত ব্যক্তির অসুস্থতা রোধ করবে। অন্যটি হলো মশার দংশনে ম্যালেরিয়া জীবাণু রক্তের মধ্যে ঢুকতে না দেয়া। এই দুুটি কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পথে আছে। তবে কোনটাই এখনও পর্যন্ত বড় ধরনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় যায়নি। ভ্যাকসিন বা ওষুধ বাদে অন্যান্য কৌশলও অধিকতর কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। গবেষকরা এনোফিলিস মশার জিন এমনভাবে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন যে, তা ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট দারুণভাবে প্রতিহত করবে। প্রজননের মধ্য দিয়ে এই নতুন জিনেটিক বৈশিষ্ট্য মশার বংশধরদের মধ্যে চলে আসবে। তবে ব্যাপক আকারে এমন মশা ছেড়ে দেয়ার জন্য অন্তত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। জিন রূপান্তরের আরও একটি পদ্ধতিও পরীক্ষাধীন আছে। আরেকটি কৌশল হলো উন্নততর নজরদারি ও রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা। এটাও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে। কড়া নজরদারি থাকলেও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারলে ম্যালেরিয়াকে দমন করে রাখা সম্ভব। ৫০ বছর আগে ম্যালেরিয়া দমনের জন্য একটিমাত্র কীটনাশকের ওপর নির্ভর করা হতো। বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এটাই ছিল একমাত্র পথ। আজ সে জায়গায় অনেক পথ খুলে গেছে। কীটনাশক ছাড়াও আছে নানা ধরনের ওষুধ, ভ্যাকসিন ও অন্যান্য কৌশল। এসব কৌশল একযোগে প্রয়োগ করা হলে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট নির্বংশ হয়ে যাবে। বিশ্বের সকল দেশ থেকে ম্যালেরিয়া বিদায় নেবে। দুনিয়াটা হয়ে দাঁড়াবে ম্যালেরিয়ামুক্ত। এই সর্বনাশা ব্যাধির অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×